দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে ২০২২ সালের আগস্টে ধর্মঘট করেছিল চা-শ্রমিকরা। ছবি: ফিলিপ গাইন
অবশেষে গত ১০ আগস্ট চা-শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে নিম্নতম মজুরী বোর্ড। চা-শ্রমিকের মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে সরকার মজুরি বোর্ড গঠন করে। মজুরি বোর্ডের জন্য একটি লজ্জার বিষয় হলো, তারা মজুরি কাঠামো নিয়ে চা-শ্রমিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য সুপারিশ তৈরি ও উপস্থাপন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কাজটি করে দিয়েছেন এবং ‘ক’ শ্রেণির বাগানের জন্য চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ঠিক হয় ১৭০ টাকা, ‘খ’ শ্রেণির জন্য ১৬৯ টাকা ও ‘গ’ শ্রেণির বাগানের জন্য ১৬৮ টাকা।
কিন্তু, প্রশ্ন হলো-প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ২০২২ সালের আগস্ট থেকে কার্যকর করার পরেও নিম্নতম মজুরী বোর্ড মজুরি কাঠামোকে আনুষ্ঠানিক করতে ও গেজেট প্রকাশ করতে এত সময় নিলো কেন?
নিম্নতম মজুরী বোর্ড চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধির সম্মতি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চা-শ্রমিক প্রতিনিধি মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুমোদন না করে পদত্যাগ করেন। তারা মজুরির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি ব্যাপারে নিম্নতম মজুরী বোর্ড আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার সময় সেগুলোকে তারা অনুমোদন করেননি। চা-শ্রমিক প্রতিনিধিকে বাদ দিয়েই নিম্নতম মজুরী বোর্ড মালিকদের ইচ্ছা পূরণ করে গেজেট প্রকাশ করে।
চা-শ্রমিক ও তাদের ইউনিয়নকে হতাশ করে এমন ৪টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে প্রথমটি হলো-মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা, বাংলাদেশীয় চা সংসদ (বিটিএ) ও চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী, বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের (বিসিএসইউ) মধ্যে দরকষাকষির মূল বিষয়গুলোর একটির আকস্মিক পরিবর্তন। ঐতিহ্যগতভাবে বিটিএ ও বিসিএসইউ প্রতি ২ বছরের জন্য শ্রম চুক্তি সই করে, মজুরি নির্ধারণ করে এবং অন্যান্য সুবিধার বিষয়ে সম্মত হয়।
চা-শিল্পে নিম্নতম মজুরী বোর্ড অনিয়মিত ও চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করতে এ পর্যন্ত ৩ বার বোর্ড গঠন করেছে। তবে এর ভূমিকা কখনো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কারণ বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে সই হওয়া শ্রম চুক্তি মোতাবেকই এতদিন মজুরি ঠিক হয়েছে।
সর্বশেষ সই হওয়া শ্রম চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে এবং ২০২১-২০২২ সময়কাল ও পরবর্তী ২ বছরের জন্য (যা চলমান) কোনো শ্রম চুক্তি এখনো সই হয়নি। মজুরি বোর্ডের অসঙ্গতি ও বিটিএর একগুঁয়েমির কারণেই প্রধানমন্ত্রী শ্রম আইনের মধ্যে থেকে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিসিএসইউ ও চা-শ্রমিকদের চরম হতাশ করা নিম্নতম মজুরী বোর্ডের গেজেটে দেখা যাচ্ছে যে, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ এখন থেকে আর বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে আলোচনার কোনো বিষয় হিসেবে থাকছে না। তারা প্রতি ২ বছর অন্তর সম্মতির ভিত্তিতে সুবিধা ও উৎপাদনশীলতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এই পরিবর্তন করা হয়েছে বিটিএর ইচ্ছা ও নিয়োগকর্তাদের স্বার্থ বিবেচনা করে, যা চা-শ্রমিকদেরকে হতাশ করেছে।
মজুরি বোর্ডে বিটিএর প্রতিনিধি এ পরিবর্তনের প্রস্তাব করলে শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরী তার বিরোধিতা করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, এই ধরনের পরিবর্তন নিয়ে বিসিএসইউ ও চা-শ্রমিকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করা উচিত, যা কখনো হয়নি। মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ অন্য সদস্যরা সবসময় বিটিএর স্বার্থে কথা বলেছেন, এটা দেখে রামভজন কৈরী মজুরি বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।
মজুরি বোর্ডে রামভজন কৈরীর জায়গায় শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে পরবর্তীতে যোগ দেন পঙ্কজ কন্দ। তিনি মাত্র একটি সভায় যোগ দেন এবং একই কারণে তিনিও পদত্যাগ করেন।
চা-শ্রমিক-যাদের অধিকাংশই অবাঙালি, হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর-শুরু থেকেই চা-বাগানের সঙ্গে বাঁধা। অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকদের থেকে তাদের অবস্থা ভিন্ন। তারা ভর্তুকি মূল্যে রেশন পান এবং বিনামূল্যে আবাসন, প্রাথমিক কিছু স্বাস্থ্যসেবা ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাসহ আরও কিছু প্রান্তিক সুবিধা পান। সব প্রান্তিক সুবিধা ১৭০ টাকার সঙ্গে যোগ করা হলে একজন চা-শ্রমিকের বর্তমান দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার কম-এমন হিসাবই দেন শ্রমিক নেতা ও শ্রমিকরা। তবে মালিকদের দাবি, তারা একজন শ্রমিককে দৈনিক যা দেন, তা ৫৪০ টাকার সমান।
বিসিএসইউর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘চা-শ্রমিক ও চা-শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিলে ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরির বার্ষিক বৃদ্ধি খুব কম এবং তা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এখন আমরা দেখছি নিম্নতম মজুরী বোর্ড মালিকদের ইচ্ছাই পূরণ করল, যা বাগানের দীর্ঘদিনের প্রথার বিরুদ্ধে গেল।’
চা-শিল্প ও শ্রমিকদের বেলায় মালিকরা যে শুধু শ্রম আইনই অনুসরণ করেন, এমন নয়। দীর্ঘদিন ধরে চা-বাগানে প্রচলিত দস্তুর বা প্রথাও তারা অনুসরণ করেন, যা শ্রম আইনে স্বীকৃত। নিম্নতম মজুরী বোর্ড ২০১০ সালের গেজেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, ‘চা শিল্পের বহু বছরের প্রতিষ্ঠিত রীতি অনুযায়ী টি-গার্ডেন শিল্প সেক্টরের চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ চা সংসদ প্রতি ২ বছর অন্তর অন্তর মজুরি ছাড়াও উৎপাদনশীলতাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।’ প্রথা চলমান থাকুক- এমনটাই চান রামভজন কৈরীসহ আরও অনেকেই।
এ বিষয়ে ট্রেড ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠ নেতা ও বিসিএসইউর প্রধান উপদেষ্টা তপন দত্তের ভাষ্য, ‘তবে ১০ আগস্টের গেজেট সুস্পষ্টভাবে বলছে যে, নিম্নতম মজুরী বোর্ড মালিকদের ইচ্ছাকেই শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কারণ চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদেরকে একরকম উপেক্ষা করা হয়েছে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
মজুরির সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো উৎসব বোনাস। ২০২৩ সালের মে মাসে বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে সই হওয়া সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মালিকপক্ষ ৫২ দিনের মজুরির সমান বোনাস দিতে সম্মত হয়েছিল। গত দুর্গা পূজায় শ্রমিকরা এই ৫২ দিনের মজুরির হিসাবে একটি উৎসব বোনাসও পান। মজুরি বোর্ড এ বোনাস কমিয়ে এখন ৪৭ দিনের মজুরির সমান করে দিয়েছে। এ হারে তারা সর্বশেষ দুর্গা পূজার আগ পর্যন্ত বোনাস পেতেন।
চা-শ্রমিকদের সব সময়ের একটি উদ্বেগের বিষয় গ্র্যাচুইটি, যা কোনো শ্রমিক কখনো পাননি। শ্রম আইন অনুযায়ী গ্র্যাচুইটির দাবি তাদের সব সময়ের। এর পরিবর্তে তারা যা পান, তা হলো অবসর গ্রহণের পর তথাকথিত পেনশন ভাতা-সপ্তাহে ২৫০ টাকা (২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা), যা ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিল ১৫০ টাকা এবং ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ২০ টাকা। বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে ২০১৭-২০১৮ সালের জন্য সই হওয়া শ্রম চুক্তিতে গ্র্যাচুইটি দিতে মালিক পক্ষ সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা তাদের এ প্রতিশ্রæতি থেকে সরে আসে এবং ফলে কেউ আর গ্র্যাচুইটি পায়নি।
ইতোমধ্যে ২০১৮ সালের শ্রম আইনের ২৮ (৩) ধারায় একটি সংশোধনী আনা হয়েছে, যা মালিকদেরকে গ্র্যাচুইটি দেওয়া থেকে অব্যাহতি দেয়। ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য সই হওয়া শ্রম চুক্তিতে এ ব্যাপারে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬/২০১৩ অনুযায়ী গ্র্যাচুইটি দেওয়া হবে।
শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, শ্রম আইনে এ সংশোধনী আনার পেছনে মালিকদের হাত ছিল। এখন নিম্নতম মজুরী বোর্ড মজুরি কাঠামোতে বিষয়টি নিয়ে এসেছে এবং স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে গ্র্যাচুইটি শুধুমাত্র কর্মচারীদের জন্য এবং শ্রমিকরা দস্তুর বা প্রথা অনুযায়ী গ্র্যাচুইটির পরিবর্তে পেনশন পাবেন।
শ্রমিকরা অবসর গ্রহণের পর যে পেনশন পান, তা গ্র্যাচুইটির তুলনায় অনেক কম। এটা অসহায় চা-শ্রমিকদের প্রতি চরম অবিচার। গ্র্যাচুইটি না দেওয়ার জন্য মালিকদের যুক্তি হলো যে, একজন শ্রমিক অবসর নেওয়ার পরে তাকে তার ঘর খালি করতে হয় না এবং তার জায়গায় তার পরিবারের অন্য একজন সদস্য কাজ পায়। গ্র্যাচুইটি এড়াতে এটি মালিকদের একটি চতুর উপায় এবং আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, চা-শ্রমিকরা, যাদের পূর্বপুরুষ চা-বাগানে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে এসেছিলেন, কীভাবে এখনো এখানে বন্দি জীবন যাপন করছেন।
এই অবস্থা বদলাতে হবে। ৫ প্রজন্ম ধরে লেবার লাইনে আবদ্ধ চা-শ্রমিক ও তাদের সম্প্রদায়কে অবশ্যই মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। শ্রম আইন ও এর প্রয়োগে যে বৈষম্য, তার অবসান ঘটাতে সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
চা-বাগানে একটি কম আলোচিত বিষয় হলো-কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশ (৫ শতাংশ)। চা বাগানের মালিকরা কখনোই চা-শ্রমিকদেরকে এ লভ্যাংশ দেননি। এখন নিম্নতম মজুরী বোর্ড গার্মেন্টস সেক্টরের মুনাফা দেওয়ার ব্যবস্থা চা-শিল্পে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, এর পরিমাণ খুবই কম-মোট বিক্রির দশমিক ০৩ শতাংশের অর্থ হলো প্রতি এক কোটি টাকা বিক্রি হলে শ্রমিকের অংশ হবে মাত্র ৩ হাজার টাকা। দ্বিতীয়ত, কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তহবিল গঠন সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন এবং গেজেট প্রকাশ সাপেক্ষে হবে। এখন, সরকার কবে এ আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করে তহবিল গঠন করে, তা দেখার বিষয়।
এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চা-শ্রমিক ও তাদের একমাত্র ইউনিয়ন কী করবে? বিসিএসইউর কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাম্প্রতিক এই মজুরি কাঠামোয় উল্লেখিত বিষয়গুলোর সংশোধন চেয়েছেন। মজুরি কাঠামো ও শ্রম আইনে বৈষম্যের অবসান এবং ন্যায্য অধিকারের জন্য সরকার ও মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে সক্ষমতা গড়ে তোলা ছাড়া তাদের জন্য এ মুহূর্তে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্ভবত নেই।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউমেন ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
নারী চা-শ্রমিক। ছবি: ফিলিপ গাইন