ফিলিপ গাইন | Newspaper Link
সোমবার, জানুয়ারি ৩০, ২০২৩ ০৩:২৮ অপরাহ্ন | মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা
চা শ্রমিকের অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ হয় যেসব বিষয়ের মাধ্যমে তার মধ্যে অন্যতম মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যকার ২ বছর অন্তর হওয়া চুক্তি। সেখানে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশীয় চা সংসদ এবং শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।
বাংলাদেশীয় চা সংসদ যেখানে চা বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ১ লাখ ৩৮ হাজার চা শ্রমিকের একমাত্র ইউনিয়ন এবং তাদের সম্মিলিত দরকষাকষির প্রতিনিধি (সিবিএ)।
এই ২ পক্ষের মধ্যে দ্বিবার্ষিক চুক্তি কখনোই সময়মতো সই হয় না। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর চুক্তি সই হয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ মাস পর চুক্তি সই হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর বাগান মালিকরা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২৬ মাসের বাড়তি মজুরি বকেয়া হিসেবে ৪ কিস্তিতে পরিশোধ করে। এই ২৬ মাসে প্রতিদিনের বাড়তি মজুরি ছিল ১৮ টাকা।
চা বাগানে এভাবে বকেয়া মজুরি পরিশোধ রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
আরও জটিল বিষয় হচ্ছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের জন্য চুক্তি এখনো সই হয়নি।
মজুরি নিয়ে চরম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মজুরি না বাড়ানোর ব্যাপারে মালিকপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ২০২২ সালের ৯ থেকে ২৭ আগস্ট নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন চা শ্রমিকরা। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ তাদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়ানো হলো। শ্রমিকদের যেখানে দাবি ছিল ৩০০ টাকা।
দাবি পুরোপুরি পূরণ না হলেও ২০ মাসের বকেয়া বাবদ ৩০ হাজার টাকা পাবেন, এমন আশা নিয়ে ২৮ আগস্ট থেকে তারা কাজে যোগদান করেন।
বাংলাদেশীয় চা সংসদের সচিব ড. কাজী মুজাফর আহমেদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থায়ী শ্রমিকরা বকেয়া বা এরিয়ার পাবেন এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে আলোচনা করে আমরা ঠিক করবো কতো কিস্তিতে বকেয়া শোধ করা হবে। তবে সংসদ অস্থায়ী শ্রমিকদের বকেয়ার ব্যাপারে কিছু করবে না, কারণ তারা আমাদের পরিধির মধ্যে পড়ে না।’
অনেক বাগানে বকেয়া পরিশোধের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু চা শ্রমিকদের জন্য বড় দুঃস্বপ্ন হলো মালিকপক্ষ চুক্তি সই নিয়ে গড়িমসি শুরু করে।
চুক্তির ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষ ধর্মঘটের আগে ১৫টির মতো সভা করে। ধর্মঘটের পরে তারা আরও বেশ কয়েকটি সভা করে। সভায় অংশগ্রহণকারী শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তাদেরকে অবাক করে মালিকপক্ষ বকেয়ার পুরো টাকা তো দূরের কথা, আংশিকও পরিশোধ করতে রাজি নয়। কাজেই শ্রমিকরা ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি পেলেও এখনো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদকালের চুক্তি সই হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতি চা বাগানে বকেয়া মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে প্রচলিত নিয়মনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
সাধারণ শ্রমিকরা বকেয়ার ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দিতে নারাজ। নারী চা শ্রমিক এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের জুরি ভ্যালির ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রীমতি বাউরি বলেন, ‘মালিক ও শ্রমিকের চুক্তিপত্র দেরিতে সই হয় এবং আমরা একটি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মেয়াদের প্রথম দিন থেকে অতিরিক্ত মজুরি বকেয়া হিসেবে পেয়ে থাকি। আমরা পূর্ণমেয়াদের জন্য দৈনিক ৫০ টাকা হারে বকেয়া চাই।’
পাতাতোলা শ্রমিক কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের বিশাখা (৪০) বলেন, ‘মালিকপক্ষ যদি চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর না করে এবং আমাদের বকেয়া পুরোপুরি শোধ না করে, তবে আমরা আবার আন্দোলন করব।’ তিনি দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন এবং দুর্গাপূজার সময় ৫ হাজার ৩০৪ টাকা উৎসব ভাতা পেয়েছেন। এই টাকা বার্ষিক উৎসব ভাতার ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৫৩৬ টাকা তিনি পাবেন ফেব্রুয়ারির ফাগুয়া উৎসবে। তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত পুরো সময়টা কাজ করেছেন। ২০ মাসের বকেয়া বাবদ তার ৩০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা।
দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এবং চা শ্রমিকদের একমাত্র ইউনিয়নের নেতারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। অসহায় শ্রমিক নেতারা ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো এক আবেদনে উল্লেখ করেছেন, গত চুক্তির মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরদিন থেকে মালিকপক্ষ বর্ধিত মজুরি বকেয়া হিসেবে পরিশোধ করতে গড়িমসি করছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অভিযোগ মালিকপক্ষের একরোখা মনোভাবের কারণে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কোনো চুক্তি সই হয়নি।
২০২১-২০২২ সালের ২ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ দিন আগে ৭ ভ্যালির ৭ সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩ সদস্য শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে ঢাকায় এক বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ইউনিয়নের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বকেয়া পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশীয় চা সংসদ দৈনিক ৫০ টাকা নয় ১৭ টাকা দিতে চাচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কোনো রকম ফলাফল ছাড়া সভার সমাপ্তি ঘটে।
যেকোনো শিল্পেই শ্রমিকদের জন্য যথাযথ মজুরি বোর্ড কাম্য। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় চা শ্রমিকের মজুরি লজ্জাজনকভাবে কম নির্ধারণ করেছে এ পর্যন্ত গঠিত ৩টি মজুরি বোর্ড। প্রথমত চা শিল্পে নূন্যতম মজুরি বোর্ড অনিয়মিত অর্থাৎ প্রতি ৫ বছর পরপর গঠিত হয়নি। দ্বিতীয়ত সর্বশেষ মজুরি বোর্ড তার এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তার ফল মোটেও ভালো হয়নি। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার পর এখনো ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠিত মজুরি বোর্ড আনুষ্ঠানিকতা সেরে মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করতে পারেনি।
যেকোনো শিল্পে মজুরি নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তায় নূন্যতম মজুরি বোর্ডের উপর। কিন্তু চা শিল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শিল্প। এ শিল্পের শ্রমিকরা চা বাগানের সীমানার মধ্যে বাস করেন। তাদের নিজেদের কোনো ভিটেমাটি নেই। উত্তরবঙ্গ বাদ দিয়ে চা বাগানের বাকি সব জমির মালিক রাষ্ট্র।
কাজেই মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের এখনকার দাবি ‘এখন থেকে মজুরি বোর্ডই মজুরি নির্ধারণ করুক’, এটা শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা না করে মানা সম্ভব নয়।
শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরীর মতে, মালিকদের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে চুক্তি ৩ বছর পরপর হোক। আর যদি রীতি অনুযায়ী ২ বছর পরপরই তা হয়, তাহলে এ চুক্তি হবে মজুরি বাদে অন্যান্য বিষয় নিয়ে। মালিকপক্ষের এসব দাবি শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরী মানেননি। তার যুক্তিসঙ্গত মত হলো, শ্রমচুক্তি ও মজুরি বোর্ডের এসব বিষয় ফয়সালা হতে হবে মালিক, শ্রমিক ও সরকারপক্ষের মধ্যে উন্মুক্ত ও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে এবং অবশ্যই শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনা করে।
চা শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ ও মজুরি বোর্ডে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আশার জন্য মালিকপক্ষকে এখনই শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে ২০২১ সারের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সারের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি সই করা উচিত। এরপর ২০২৩ সালে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তির মেয়াদ শুরু হয়ে যাবে। আর নূন্যতম মজুরি বোর্ডকেই যদি চা শিল্পে মজুরি নির্ধারণ করতে হয়, তবে শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুসরণ করে চা শ্রমিকের জীবনযাপনের ব্যয় এবং অন্যান্য শিল্পের নূন্যতম মজুরি বিবেচনায় নিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)