চা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ন্যায্যতা কোথায়

চা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ন্যায্যতা কোথায়

ফিলিপ গাইন | Newspaper Link
সোমবার, জানুয়ারি ৩০, ২০২৩ ০৩:২৮ অপরাহ্ন | মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

চা শ্রমিকের অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ হয় যেসব বিষয়ের মাধ্যমে তার মধ্যে অন্যতম মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যকার ২ বছর অন্তর হওয়া চুক্তি। সেখানে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশীয় চা সংসদ এবং শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।

বাংলাদেশীয় চা সংসদ যেখানে চা বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ১ লাখ ৩৮ হাজার চা শ্রমিকের একমাত্র ইউনিয়ন এবং তাদের সম্মিলিত দরকষাকষির প্রতিনিধি (সিবিএ)।

এই ২ পক্ষের মধ্যে দ্বিবার্ষিক চুক্তি কখনোই সময়মতো সই হয় না। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর চুক্তি সই হয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ মাস পর চুক্তি সই হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর বাগান মালিকরা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২৬ মাসের বাড়তি মজুরি বকেয়া হিসেবে ৪ কিস্তিতে পরিশোধ করে। এই ২৬ মাসে প্রতিদিনের বাড়তি মজুরি ছিল ১৮ টাকা।

চা বাগানে এভাবে বকেয়া মজুরি পরিশোধ রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
আরও জটিল বিষয় হচ্ছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের জন্য চুক্তি এখনো সই হয়নি।

মজুরি নিয়ে চরম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মজুরি না বাড়ানোর ব্যাপারে মালিকপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ২০২২ সালের ৯ থেকে ২৭ আগস্ট নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন চা শ্রমিকরা। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ তাদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়ানো হলো। শ্রমিকদের যেখানে দাবি ছিল ৩০০ টাকা।

দাবি পুরোপুরি পূরণ না হলেও ২০ মাসের বকেয়া বাবদ ৩০ হাজার টাকা পাবেন, এমন আশা নিয়ে ২৮ আগস্ট থেকে তারা কাজে যোগদান করেন।

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সচিব ড. কাজী মুজাফর আহমেদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থায়ী শ্রমিকরা বকেয়া বা এরিয়ার পাবেন এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে আলোচনা করে আমরা ঠিক করবো কতো কিস্তিতে বকেয়া শোধ করা হবে। তবে সংসদ অস্থায়ী শ্রমিকদের বকেয়ার ব্যাপারে কিছু করবে না, কারণ তারা আমাদের পরিধির মধ্যে পড়ে না।’

অনেক বাগানে বকেয়া পরিশোধের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু চা শ্রমিকদের জন্য বড় দুঃস্বপ্ন হলো মালিকপক্ষ চুক্তি সই নিয়ে গড়িমসি শুরু করে।

চুক্তির ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষ ধর্মঘটের আগে ১৫টির মতো সভা করে। ধর্মঘটের পরে তারা আরও বেশ কয়েকটি সভা করে। সভায় অংশগ্রহণকারী শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তাদেরকে অবাক করে মালিকপক্ষ বকেয়ার পুরো টাকা তো দূরের কথা, আংশিকও পরিশোধ করতে রাজি নয়। কাজেই শ্রমিকরা ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি পেলেও এখনো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদকালের চুক্তি সই হচ্ছে না।

এ পরিস্থিতি চা বাগানে বকেয়া মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে প্রচলিত নিয়মনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সাধারণ শ্রমিকরা বকেয়ার ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দিতে নারাজ। নারী চা শ্রমিক এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের জুরি ভ্যালির ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রীমতি বাউরি বলেন, ‘মালিক ও শ্রমিকের চুক্তিপত্র দেরিতে সই হয় এবং আমরা একটি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মেয়াদের প্রথম দিন থেকে অতিরিক্ত মজুরি বকেয়া হিসেবে পেয়ে থাকি। আমরা পূর্ণমেয়াদের জন্য দৈনিক ৫০ টাকা হারে বকেয়া চাই।’

পাতাতোলা শ্রমিক কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের বিশাখা (৪০) বলেন, ‘মালিকপক্ষ যদি চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর না করে এবং আমাদের বকেয়া পুরোপুরি শোধ না করে, তবে আমরা আবার আন্দোলন করব।’ তিনি দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন এবং দুর্গাপূজার সময় ৫ হাজার ৩০৪ টাকা উৎসব ভাতা পেয়েছেন। এই টাকা বার্ষিক উৎসব ভাতার ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৫৩৬ টাকা তিনি পাবেন ফেব্রুয়ারির ফাগুয়া উৎসবে। তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত পুরো সময়টা কাজ করেছেন। ২০ মাসের বকেয়া বাবদ তার ৩০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা।

দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এবং চা শ্রমিকদের একমাত্র ইউনিয়নের নেতারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। অসহায় শ্রমিক নেতারা ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো এক আবেদনে উল্লেখ করেছেন, গত চুক্তির মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরদিন থেকে মালিকপক্ষ বর্ধিত মজুরি বকেয়া হিসেবে পরিশোধ করতে গড়িমসি করছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অভিযোগ মালিকপক্ষের একরোখা মনোভাবের কারণে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কোনো চুক্তি সই হয়নি।

২০২১-২০২২ সালের ২ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ দিন আগে ৭ ভ্যালির ৭ সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩ সদস্য শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে ঢাকায় এক বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ইউনিয়নের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বকেয়া পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশীয় চা সংসদ দৈনিক ৫০ টাকা নয় ১৭ টাকা দিতে চাচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কোনো রকম ফলাফল ছাড়া সভার সমাপ্তি ঘটে।

যেকোনো শিল্পেই শ্রমিকদের জন্য যথাযথ মজুরি বোর্ড কাম্য। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় চা শ্রমিকের মজুরি লজ্জাজনকভাবে কম নির্ধারণ করেছে এ পর্যন্ত গঠিত ৩টি মজুরি বোর্ড। প্রথমত চা শিল্পে নূন্যতম মজুরি বোর্ড অনিয়মিত অর্থাৎ প্রতি ৫ বছর পরপর গঠিত হয়নি। দ্বিতীয়ত সর্বশেষ মজুরি বোর্ড তার এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তার ফল মোটেও ভালো হয়নি। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার পর এখনো ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠিত মজুরি বোর্ড আনুষ্ঠানিকতা সেরে মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করতে পারেনি।

যেকোনো শিল্পে মজুরি নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তায় নূন্যতম মজুরি বোর্ডের উপর। কিন্তু চা শিল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শিল্প। এ শিল্পের শ্রমিকরা চা বাগানের সীমানার মধ্যে বাস করেন। তাদের নিজেদের কোনো ভিটেমাটি নেই। উত্তরবঙ্গ বাদ দিয়ে চা বাগানের বাকি সব জমির মালিক রাষ্ট্র।

কাজেই মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের এখনকার দাবি ‘এখন থেকে মজুরি বোর্ডই মজুরি নির্ধারণ করুক’, এটা শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা না করে মানা সম্ভব নয়।

শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরীর মতে, মালিকদের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে চুক্তি ৩ বছর পরপর হোক। আর যদি রীতি অনুযায়ী ২ বছর পরপরই তা হয়, তাহলে এ চুক্তি হবে মজুরি বাদে অন্যান্য বিষয় নিয়ে। মালিকপক্ষের এসব দাবি শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরী মানেননি। তার যুক্তিসঙ্গত মত হলো, শ্রমচুক্তি ও মজুরি বোর্ডের এসব বিষয় ফয়সালা হতে হবে মালিক, শ্রমিক ও সরকারপক্ষের মধ্যে উন্মুক্ত ও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে এবং অবশ্যই শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনা করে।

চা শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ ও মজুরি বোর্ডে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আশার জন্য মালিকপক্ষকে এখনই শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে ২০২১ সারের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সারের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি সই করা উচিত। এরপর ২০২৩ সালে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তির মেয়াদ শুরু হয়ে যাবে। আর নূন্যতম মজুরি বোর্ডকেই যদি চা শিল্পে মজুরি নির্ধারণ করতে হয়, তবে শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুসরণ করে চা শ্রমিকের জীবনযাপনের ব্যয় এবং অন্যান্য শিল্পের নূন্যতম মজুরি বিবেচনায় নিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে।

ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

No justice in paying tea workers’ arrears

No justice in paying tea workers’ arrears

by Philip Gain | Newsper Link
Sun Jan 29, 2023 08:00 AM Last update on: Sun Jan 29, 2023 08:00 AM | PHOTO: MOSTAFA SHABUJ

Foremost of the factors that determine the economic fate of tea workers in Bangladesh is the agreement that the Bangladesh Tea Association (BTA) and Bangladesh Cha Sramik Union (BCSU) sign every two years. While BTA represents owners of the tea gardens, BCSU is the only trade union for around 1,38,000 tea workers and their combined bargaining agent (or CBA).

However, this bi-annual agreement is never signed on time. For instance, the agreement effective for January 1, 2019 to December 31, 2020 was signed on February 25, 2021. The tea workers got their additional pay for 26 months in arrears in four instalments. Additional cash pay for these 26 months was Tk 18 per day.

For all latest news, follow The Daily Star’s Google News channel.

More baffling is the fact that no agreement has yet been signed for the period from January 1, 2021 to December 31, 2022. Such payment of arrears has become part of the culture in Bangladesh’s tea gardens.

Extremely dissatisfied with this delay and the stubbornness of BTA in not increasing wages, the tea workers went on an unprecedented strike from August 9 to 27 in 2022. Finally, the prime minister stepped in and fixed the daily cash pay at Tk 170, which is an increase of Tk 50 and Tk 130 less than what workers had demanded.

Still, they went back to work from August 28 in hopes that they would get the increased wage from January 2023. A registered worker who had worked all days during the 20-month arrear period would get Tk 30,000, a good sum for the impoverished tea workers.

Dr Kazi Muzafar Ahmed, secretary of the BTA, said in an interview with The Business Post last August, “The permanent workers will get arrears, and we will set the number of instalments in a meeting with the BCSU. The association will not facilitate any arrears for casual workers, as they are out of our purview.” Some gardens were preparing to roll such payment as well.

But the owners’ fickleness about signing of the agreement has come as a big shock to tea garden workers.

The BTA and BCSU had already had 15 meetings before the August 2022 strike, to reach an agreement. After the strike ended, they held several meetings. The tea workers’ representatives were shocked to find that owners were now reluctant to even pay part of the arrear, let alone the full. So, even though workers started receiving the daily cash pay of Tk 170 from August 28, 2022, there has been no headway for signing the January 1, 2021 to December 31, 2022 agreement. This situation contravenes the tradition regarding payment of arrears.

And common tea workers are reluctant to compromise: “The agreement between the owners and workers is signed late and we get the increased pay in arrears from the first day of the following agreement period,” says Sreemati Bauri (40), a tea worker and vice president of BCSU’s Juri Valley committee. “We want our full arrears at the rate of Tk 50 per day for the full agreement period.”

“If the owners do not sign and execute the agreement starting from January 1, 2021 and do not pay our arrears in full, we will go on strike again,” said tealeaf picker Bisakha (40) of Madhobpur Tea Estate in Kamalganj upazila.

The leaders of BCSU are having a hard time negotiating with the owners. Helpless, they have sent an appeal to the PM dated November 14, 2022 in which they pointed out that the owners are now reluctant to pay the increased daily wage starting after the expiration of the last agreement period. BCSU alleges that the arrogance of the owners is causing delay in the signing of the agreement even after the agreement period ended on December 31, 2022.

Three days before the end of the 2021-22 agreement period, a 10-member team of seven vice presidents of seven valleys and three central committee members of BCSU met the Director General of the Department of Labour (DL) in Dhaka. A number of the labour leaders have said that they have learned from an official of the Department of Labour that the owners were willing to pay the arrears at the rate of Tk 17 a day, not Tk 50. Some BCSU leaders were reportedly ready to compromise and accept arrears between Tk 25 and Tk 30. But the majority of leaders rejected this and the meeting ended with no positive outcome.

The three minimum wage boards set up so far for the tea industry have fixed much lower wages compared to other industries. First, the minimum wage board is irregular in the tea industry as it is not formed every five years. Second, the latest minimum wage board interfered in affairs beyond its jurisdiction and the outcome turned out to be unpredictably sad. The current wage board, set up in October 2019, has not even published the gazette finalising the wage structure.

In any industry, the responsibility of fixing wages is bestowed upon the minimum wage board. However, the tea industry is entirely exceptional. The workers in this industry live within the boundaries of the tea gardens. They do not have homesteads of their own. The state owns the land of the tea gardens, excluding those in north Bengal.

Therefore, the current proposal of the BTA to the government to “let the minimum wage board fix the wage” is not acceptable without elaborate discussion with workers.

According to Rambhajan Kairi, the workers’ representative, another BTA proposal is that the agreement between the BTA and BCSU be signed every three years. BTA also suggests if the agreement is signed every two years following the long tradition, it should deal with all other issues except wages. But Kairi’s reasonable argument is that the owners, tea workers, and the state must have open and elaborate discussions before bringing any change to the current tradition. And the workers’ interest must get the right consideration in such discussions.

For an exit out of the current stalemate, the BTA should immediately accept the legitimate demand of tea garden workers and sign the agreement for the period from January 1, 2021 to December 31, 2022. Then, the negotiation would be due for the following agreement period starting on January 1, 2023. On another note, if the minimum wage board is regularised in the tea industry, it must grant pragmatic consideration to the living costs of tea workers and other factors that section 141 of the labour laws mentions.

Phillip Gain is researcher and director at the Society for Environment and Human Development (SEHD).

কমলা দাসীদের দুঃখ কি এ বছর যাবে

কমলা দাসীদের দুঃখ কি এ বছর যাবে

ফিলিপ গাইন | bangla.thedailystar.net
মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৩, ২০২৩ ১২:৫৯ অপরাহ্ন | চা-বাগানের নারী শ্রমিক। ছবি: ফিলিপ গাইন

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় ৬৯ বছর বয়সী নারী কমলা দাসী প্রায় ৩৫ বছর আগে বিধবা হয়েছেন এবং গত ১৫ বছর ধরে তিনি বিধবা ভাতা পাচ্ছেন। প্রথম দিকে ভাতা পেতেন ২০০ টাকা। এখন পান ৫০০ টাকা।

বাল্য বয়সেই কমলার বিয়ে হয় পাগলা দাসের সঙ্গে, যিনি আগে আরও ৪টি বিয়ে করেন এবং ৪ জনই ১টি করে ছেলে রেখে মারা যান। প্রথম ৪ স্ত্রী মারা যাওয়ার পরই কমলার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পাগলা দাসের মৃত্যুর পর নিজের মেয়ে ও ৪ সৎ ছেলেকে নিয়ে তার সংগ্রাম শুরু হয়। কোনো রকম স্বাক্ষরজ্ঞানহীন কমলা দিনমজুরি ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়ে ও ৪ ছেলেকে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন। ছেলেরা বড় হলে কমলা দাসীকে তাদের বাবার কুঁড়ে ঘরে রেখে নিজেরা আলাদা সংসার করে। মেয়েকে বিয়ে দেন। ৩ বছর আগে সেও মারা গেলে কমলা একা হয়ে পড়েন। খাবার, পোশাক ও থাকার জায়গা জোগাড় করাই তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন।

সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
কমলা দাসীর মতো দুঃস্থ নারীদের জন্য সরকারের একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে, যার নাম ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’। এটি বাংলাদেশে বর্তমানে যে ১১৫টি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর একটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর বাজেট ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ কর্মসূচি থেকে ৫৭ লাখ নারী উপকার পাচ্ছেন।

নতুন বছরে এ কর্মসূচির বাজেট ও উপকারভোগীর সংখ্যা আগের বছরের মতোই। অর্থাৎ বর্তমান অর্থবছরে উপকারভোগীর তালিকায় কোনো নতুন নাম যোগ হয়নি। এটি বেশ খারাপ খবর যে বিধবা ভাতা নামে অধিক পরিচিত এ ভাতায় নতুন কোনো নাম চলতি বছরে আর যোগ হচ্ছে না। অথচ অনেক বিধবা ও দুঃস্থ নারীর জন্য এ ভাতা খুব দরকার। জানা গেছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর যে ৮টি নগদ অর্থ প্রদানকারী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্পাদন করে, বয়স্ক ভাতাসহ সেসবের ৬টিতে নতুন নাম সংযোজন বন্ধ রেখেছে।

আর যারা তালিকায় আছেন, তারা যা পান, তা যৎসামান্য। মাসে ৫০০ টাকা দিয়ে কমলা দাসীর মতো একজন নারী কী করতে পারেন? এই বৃদ্ধ বয়সে ওষুধের পেছনেই তাকে মাসে ৮০০ টাকার মতো খরচ করতে হয়। কমলা বলেছেন, মাসে যদি ৩ হাজার টাকা পেতেন, তবে তাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু এখন যে টাকাটা পান, তা কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

কমলা দাসীর মতো লাখো নারী আছেন, যারা এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না। তালা উপজেলার খেসড়া ইউনিয়নের ৪৮ বছর বয়সী নূরজাহান তাদেরই একজন। ৩ ছেলে-মেয়ে রেখে তার স্বামী মারা গেছেন ২০০৫ সালে, যাদের বয়স এখন ২৩ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে অনেকবার গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কখনো বিধবা ভাতার জন্য কার্ড করতে পারেননি। কেউ তার কাছে ঘুষ না চাইলেও তার ধারণা, যদি তিনি কিছু খরচ করতে পারতেন, তবে ভাতা প্রদানের জন্য যারা তালিকা করেন, তারা তার দিকে নজর দিতেন।

নূরজাহান কৃষিশ্রমিক এবং ১ শতক জমির ওপর তার ভিটে। তিনি তার আশেপাশের অনেককে চেনেন যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো অথচ বিধবা ভাতা পাওয়ার তালিকায় তাদের নাম আছে। তিনি যা বলছেন, তার মানে হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাদের অনেককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা ভুল করে উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা সরকারি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

মাঠ অনুসন্ধান ও কেস ডকুমেন্টেশন থেকে অনেক জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে এমন অনেকে উপকার পেয়েছেন, যাদের পাওয়ার কথা নয়। উপকারভোগী নির্বাচনে এমন ভুলের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ছেন। কারণ প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিটি কর্মসূচির জন্য উপকারভোগীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তরণের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৪২ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে উপকার পায় না। এতে উপকারভোগী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার অবস্থাটা আঁচ করা যায়।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বাদ পড়া নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন সব পরিবারের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশের মাথাপিছু আয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের আয়ের দ্বিগুণ। যেসব কারণে এমন অনিয়ম হচ্ছে, তার মধ্যে উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনা, দক্ষতার অভাব, দুর্বল শাসন, জটিল প্রশাসন, দায়বদ্ধতার অভাব ও দুর্নীতি অন্যতম। এসবের মধ্যে আবার প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত, বাদপড়া ও ভূমিহীন গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে ঘাটতি বেশি।

বিগত বছরগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা সামগ্রিকভাবে বাড়লেও বাজেটের একটা বড় অংশ যাচ্ছে যারা দরিদ্র নয় এমন মানুষের কাছে। যেমন: ২০২১-২০২২ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ৬ লাখ ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর অবসর ভাতা এবং ২ লাখ ১৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা, সম্মানী ও চিকিৎসা বাবদ প্রদান করা হয়েছে। একই অর্থবছরে এই বাজেট থেকে ১০ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) জন্য ভর্তুকি দিতে। বিশ্বব্যাপী অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

বিভিন্ন সূত্রমতে, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মোট বাজেট থেকে দরিদ্র নয় এমন মানুষের হাতে যেসব সুবিধা যাচ্ছে, তা যদি বাদ দেওয়া হয়, তবে জিডিপির ১ শতাংশেরও কম যায় দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে কাগজে কলমে তা জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। পিছিয়ে পড়া মানুষ, তা সে হোক ভূমিহীন, দুঃস্থ নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সামাজিকভাবে অচ্ছুত, দরিদ্র অথবা হতদরিদ্র, বাজেটে এ ধরনের বরাদ্দ তাদের কারোরই কাম্য নয়।

হরিজন, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত চা-শ্রমিক, হিজড়া, বেদে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতি ও পেশাগত সম্প্রদায় ও এই অঞ্চলের খাদ্য সহায়তা পায় এমন সব জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৮ রকম সুবিধা বরাদ্দ আছে। এই বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-২০২২ সালে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা, যা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের দশমিক ৯৩ শতাংশ। উপকারভোগীর প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় এই বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কম। তাই কিছু সাহায্য পেলেও তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ও আধুনিক দাসত্ব থেকে তাদের বের করে আনতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।

আধুনিক দাসত্বের জালে আটকে পড়া যৌনকর্মী, যারা প্রতিনিয়ত চরম সহিংসতা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হন, তাদের জন্য বাজেটে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। পুনর্বাসনসহ নিজেদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য একটি আলাদা কর্মসূচির দাবি তাদের। এমন দাবি অযৌক্তিক নয়, বরং যথাযোগ্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের ১১টি যৌনপল্লী, বিভিন্ন হোটেল, বাসা-বাড়ি ও রাস্তায় কর্মরত প্রায় ১ লাখ যৌনকর্মীর অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক। সন্তানদের শিক্ষার জন্যও প্রয়োজন সাহায্যের। এমন মানবেতর জীবনযাপন সত্ত্বেও তারা আমাদের সমাজের কারো বিবেচনায় আসেন না, থেকে যান নজরের বাইরে।

আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ভূমিহীন অথবা কার্যত ভূমিহীন। খাস জমি ও ভূমিহীন জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যেসব তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে, তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের মোট পরিবারের প্রায় ৭৭ শতাংশ হয় সম্পূর্ণ ভূমিহীন অথবা ভাড়া নিয়ে অন্যের জমি ব্যবহারকারী এবং ৫ শতাংশ ভূমির মালিকানা আছে এমন।

একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সেখানকার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমির মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে ৩৩ লাখের মতো সরকারি খাস জমি রয়েছে, যা ভূমিহীন মানুষের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব। এর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে একটি আলাদা কার্যক্রম চালুর প্রস্তাবও ইতোমধ্যে সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এরকম বিশেষ কার্যক্রম দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের আদর্শ হিসেবেও কাজ করতে পারে।

সামনের দিনগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও কার্যকরী করে তোলার অনেক বড় দায়িত্ব এখন সরকারের। একদিকে সরকারকে যেমন এসব কর্মসূচির যথার্থ বাস্তবায়নে বিভিন্ন অনিয়ম দূর করতে হবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনসংখ্যার ওপর সুষ্ঠু তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং উপকারভোগীর একটি বাস্তব ও প্রকৃত তালিকা নির্ধারণ করতে হবে, এর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের অবসর ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ— এই কার্যক্রমগুলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে আলাদা করতে হবে, যেন প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি ও প্রাপ্ত ভাতার পরিমাণ সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পায়।

এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত প্রকৃত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে। এই উদ্দেশ্যে যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কেবল তখনই বাংলাদেশের পক্ষে তার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়নের যে মূল উদ্দেশ্য, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতি গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে মানবিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের মানুষের কল্যাণ সাধন’, তা অর্জন করা সম্ভব হবে।

তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে লেখককে সাহায্য করেছেন ফাহমিদা আফরোজ নাদিয়া, মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও সাবরিনা মিতি গাইন।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের (সেড) পরিচালক

Philip.gain@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Expand social protection in the new year

Expand social protection in the new year

by Philip Gain, The Daily Star, January 1, 2023 | Bangla Edition | English Edition

Kamala Dashi, 69, a Rishi woman from the Tala upazila of Satkhira district, became a widow around 35 years ago, and has been receiving a widow allowance for the last 15 years. Initially, this was Tk 200 per month, which over the years rose to Tk 500. Even then, this is too little an amount for a woman caught in extreme poverty.

Forced into marriage as a child, Kamala was the fifth wife of her husband Pagla Das, who married her after all four of his wives died, leaving behind four sons to take care of. After marriage, she gave birth to a daughter, and when Pagla Das died, she had to care of five children. Deprived of any literacy, she did so by earning a meagre income as a day labourer and domestic help.

Eventually, the sons grew up and moved out, leaving their stepmother in their father’s hut. Her daughter was married off and died three years ago, leaving Kamala completely alone in the world. She now has a difficult time managing food, clothes and proper shelter, sometimes begging and sometimes working as a domestic help to survive.

The government has a social safety net programme (SSNP) for women like Kamala Dashi, called Allowances for the Widow, Deserted and Destitute Women. This is one of the major initiatives of a total of 115 SSNPs, with a budget of Tk 3,444.54 crore (approximately USD 328 million) for the current fiscal year. The number of widows and deserted women benefitting from this programme is 5.7 million.

However, the budget and beneficiaries were the same in the previous fiscal year, which means no new woman has been added to the list. This is indeed sad news, that new enlistment for this SSNP, popularly known as widow allowance, has been suspended for women who need social protection the most. The Department of Social Services (DSS) under the Ministry of Social Welfare, which administers this programme, has also reportedly suspended new enlistment for six out of the eight SSNPs that give out cash allowances, including the old age allowance.

And for those who are on the list, the monthly amount of financial aid is grossly inadequate. What can a woman like Kamala Dashi do with a monthly allowance of Tk 500? In her old age, she needs to spend around Tk 800 on medicine alone. According to Kamala, Tk 3,000 would be enough for her to meet her monthly expenses, but the cash allowance she currently receives barely lasts a few days.

On top of that, there are hundreds of thousands of women like Kamala who do not get the allowance they are eligible for. One of them is 48-year-old Nurjahan from the Khesra union of Tala upazila. Her husband died in 2005, leaving her with three children who are now aged between 23 and 28. However, she never received the widow allowance, even though she visited her union parishad and tried several times. Although no one ever demanded a bribe, Nurjahan’s impression is that if she had offered money, she would have been given more attention.

Nurjahan is an agricultural labourer and has a tiny house on one decimal of land. According to her, there are others in her area who have been included on the widow allowance list, even though they are economically better off than her. What she is saying points to inclusion and exclusion errors in selecting SSNP beneficiaries, which is a big concern for the executing state agencies.

Field investigations and case documentation have produced strong evidence that there definitely are recipients of SSNP benefits who do not qualify for them but receive them anyway. And due to these inclusion errors, many eligible candidates are excluded, since the number of beneficiaries is fixed for each union parishad. In a survey that I recently conducted for UTTARAN, a Satkhira-based development organisation, 59.5 percent of 442 landless families were found to not be under any SSNP coverage. This reflects the state of exclusion errors.

According to another study by Policy Research Institute (PRI) on barriers to access, as many as 36.4 percent of households covered in these programmes have a per capita income that is more than double the threshold level income set for vulnerable groups. Some of the factors that contribute to this are political considerations in selection of beneficiaries, lack of efficiency, weak governance, complex administration, lack of accountability and corrupt practices. In all of these, what is most concerning is the lack of access to SSNPs for marginalised, disadvantaged, excluded and landless groups.

Overall, the budget allocation for SSNPs by the government has increased over the years, as has the number of beneficiaries. However, a large portion of the programme funds end up in the hands of the country’s non-poor. For instance, 25.18 percent of the Tk.111,467 crore social safety net budget for fiscal year 2021-22 (revised) was spent on pensions for 630,000 government employees and honorariums for 213,000 freedom fighters. Another Tk 10,756 crore (revised) or 9.65 percent of the budget was allocated for interest payments on national savings certificates and interest subsidies for loans to small and medium enterprises (including cottage industries). Globally, benefits like pension and interests on savings certificates for the non-poor are not considered part of social security programmes.

According to different sources, if all non-poor related benefits are excluded from the total SSNP budget, less than one percent of GDP goes to the poor, even though on paper, the social protection budget amounted to 2.8 percent of GDP in FY2021-2022. This is not a picture that those left behind – be they landless, women in destitution, marginalised communities, social outcasts, the poor and the extreme poor – would like to see.

Having said that, there are eight SSNPs for some of the most marginalised groups in the country. This includes, but is not limited to, Harijans, marginal and disadvantaged tea workers, the transgender (Hijra) population, the Bede community, smaller ethnic communities and occupational groups in special areas outside the Chittagong Hill Tracts (CHT), and recipients of food assistance in the CHT. But while the population eligible for these SSNPs is pretty large, the budget is only Tk 1,038.67 crore, or 0.93 percent of the total SSNP budget. So even though these communities do have access to some benefits, they need more financial support to migrate out of a vicious cycle of poverty and working conditions that amount to modern-day slavery.

There is also no special consideration for sex workers, a majority of whom are trapped in modern-day slavery and face extreme forms of violence, exploitation and abuse. Their demand for a special SSNP for their wellbeing, which would include rehabilitation, is legitimate and should be taken into account. Many of the around 100,000 sex workers, who work in 11 brothels, hotels, residences and on the streets, want to change their occupation. They also need support to educate their children. Yet, they continue to go unnoticed, and are uncared for in our society.

Another concern is the fact that a huge proportion of households in Bangladesh are either landless or functionally landless. I examined data on khas land and landless populations generated by the Bangladesh Bureau of Statistics and other non-state sources, and found that almost 77 percent of total households in the country are either completely landless, tenants, or are households operating on 0.05 acres of land.

Access to land for the poor and marginalised is obviously crucial for sustainable development. It is estimated that there are 3.3 million acres of public (khas) land that could be distributed amongst the landless poor, and demands have already been put forward to the government to consider initiating an SSNP to distribute khas land among the landless. This could also be a strategic social security programme for poverty alleviation.

The government has a huge task ahead in terms of making its social security programmes effective. On the one hand, the government needs to clear up the anomalies in executing specific SSNPs, develop a database on poor and marginalised households, and set targets with practical guidance. On the other hand, it needs to separate pensions, freedom fighters’ benefits and savings certificates from SSNPs, and increase the coverage and budgets of SSNPs to provide real social protection to those who need it most.

Expanding coverage should be a top priority for the authorities, and the work for this should be started immediately. It is only then that Bangladesh will be able to achieve the key objective of the National Social Security Strategy of building “an inclusive Social Security System for all deserving Bangladeshis that effectively tackles and prevents poverty and inequality and contributes to broader human development, employment and economic growth.”

Fahmida Afroze Nadia, Md Mustafizur Rahman and Sabrina Miti Gain helped the writer in collection and analysis of data.

Philip Gain is a researcher and director at the Society for Environment and Human Development (SEHD).

_____________________________________________________________________________________________________________

Bangla Edition

কমলা দাসীদের দুঃখ কি এ বছর যাবে

সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায় ৬৯ বছর বয়সী নারী কমলা দাসী প্রায় ৩৫ বছর আগে বিধবা হয়েছেন এবং গত ১৫ বছর ধরে তিনি বিধবা ভাতা পাচ্ছেন। প্রথম দিকে ভাতা পেতেন ২০০ টাকা। এখন পান ৫০০ টাকা।

বাল্য বয়সেই কমলার বিয়ে হয় পাগলা দাসের সঙ্গে, যিনি আগে আরও ৪টি বিয়ে করেন এবং ৪ জনই ১টি করে ছেলে রেখে মারা যান। প্রথম ৪ স্ত্রী মারা যাওয়ার পরই কমলার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পাগলা দাসের মৃত্যুর পর নিজের মেয়ে ও ৪ সৎ ছেলেকে নিয়ে তার সংগ্রাম শুরু হয়। কোনো রকম স্বাক্ষরজ্ঞানহীন কমলা দিনমজুরি ও অন্যের বাড়িতে কাজ করে মেয়ে ও ৪ ছেলেকে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকেন। ছেলেরা বড় হলে কমলা দাসীকে তাদের বাবার কুঁড়ে ঘরে রেখে নিজেরা আলাদা সংসার করে। মেয়েকে বিয়ে দেন। ৩ বছর আগে সেও মারা গেলে কমলা একা হয়ে পড়েন। খাবার, পোশাক ও থাকার জায়গা জোগাড় করাই তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা রোজগার করেন, তা দিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন।

কমলা দাসীর মতো দুঃস্থ নারীদের জন্য সরকারের একটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আছে, যার নাম ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’। এটি বাংলাদেশে বর্তমানে যে ১১৫টি প্রধান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলোর একটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর বাজেট ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এ কর্মসূচি থেকে ৫৭ লাখ নারী উপকার পাচ্ছেন।

নতুন বছরে এ কর্মসূচির বাজেট ও উপকারভোগীর সংখ্যা আগের বছরের মতোই। অর্থাৎ বর্তমান অর্থবছরে উপকারভোগীর তালিকায় কোনো নতুন নাম যোগ হয়নি। এটি বেশ খারাপ খবর যে বিধবা ভাতা নামে অধিক পরিচিত এ ভাতায় নতুন কোনো নাম চলতি বছরে আর যোগ হচ্ছে না। অথচ অনেক বিধবা ও দুঃস্থ নারীর জন্য এ ভাতা খুব দরকার। জানা গেছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর যে ৮টি নগদ অর্থ প্রদানকারী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্পাদন করে, বয়স্ক ভাতাসহ সেসবের ৬টিতে নতুন নাম সংযোজন বন্ধ রেখেছে।

আর যারা তালিকায় আছেন, তারা যা পান, তা যৎসামান্য। মাসে ৫০০ টাকা দিয়ে কমলা দাসীর মতো একজন নারী কী করতে পারেন? এই বৃদ্ধ বয়সে ওষুধের পেছনেই তাকে মাসে ৮০০ টাকার মতো খরচ করতে হয়। কমলা বলেছেন, মাসে যদি ৩ হাজার টাকা পেতেন, তবে তাকে এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। কিন্তু এখন যে টাকাটা পান, তা কয়েক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।

কমলা দাসীর মতো লাখো নারী আছেন, যারা এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু পাচ্ছেন না। তালা উপজেলার খেসড়া ইউনিয়নের ৪৮ বছর বয়সী নূরজাহান তাদেরই একজন। ৩ ছেলে-মেয়ে রেখে তার স্বামী মারা গেছেন ২০০৫ সালে, যাদের বয়স এখন ২৩ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে অনেকবার গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কখনো বিধবা ভাতার জন্য কার্ড করতে পারেননি। কেউ তার কাছে ঘুষ না চাইলেও তার ধারণা, যদি তিনি কিছু খরচ করতে পারতেন, তবে ভাতা প্রদানের জন্য যারা তালিকা করেন, তারা তার দিকে নজর দিতেন।

নূরজাহান কৃষিশ্রমিক এবং ১ শতক জমির ওপর তার ভিটে। তিনি তার আশেপাশের অনেককে চেনেন যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভালো অথচ বিধবা ভাতা পাওয়ার তালিকায় তাদের নাম আছে। তিনি যা বলছেন, তার মানে হলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য যারা নির্বাচিত হচ্ছেন, তাদের অনেককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বা ভুল করে উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা সরকারি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।

মাঠ অনুসন্ধান ও কেস ডকুমেন্টেশন থেকে অনেক জোড়ালো প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে এমন অনেকে উপকার পেয়েছেন, যাদের পাওয়ার কথা নয়। উপকারভোগী নির্বাচনে এমন ভুলের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী বাদ পড়ছেন। কারণ প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিটি কর্মসূচির জন্য উপকারভোগীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। সাতক্ষীরাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উত্তরণের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৪৪২ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে উপকার পায় না। এতে উপকারভোগী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার অবস্থাটা আঁচ করা যায়।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বাদ পড়া নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এমন সব পরিবারের ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশের মাথাপিছু আয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের আয়ের দ্বিগুণ। যেসব কারণে এমন অনিয়ম হচ্ছে, তার মধ্যে উপকারভোগী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিবেচনা, দক্ষতার অভাব, দুর্বল শাসন, জটিল প্রশাসন, দায়বদ্ধতার অভাব ও দুর্নীতি অন্যতম। এসবের মধ্যে আবার প্রান্তিক, সুবিধাবঞ্চিত, বাদপড়া ও ভূমিহীন গোষ্ঠীগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে ঘাটতি বেশি।

বিগত বছরগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও উপকারভোগীর সংখ্যা সামগ্রিকভাবে বাড়লেও বাজেটের একটা বড় অংশ যাচ্ছে যারা দরিদ্র নয় এমন মানুষের কাছে। যেমন: ২০২১-২০২২ সালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের ২৫ দশমিক ১৮ শতাংশ ৬ লাখ ৩০ হাজার সরকারি কর্মচারীর অবসর ভাতা এবং ২ লাখ ১৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা, সম্মানী ও চিকিৎসা বাবদ প্রদান করা হয়েছে। একই অর্থবছরে এই বাজেট থেকে ১০ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা বাজেটের ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (কুটির শিল্পসহ) জন্য ভর্তুকি দিতে। বিশ্বব্যাপী অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

বিভিন্ন সূত্রমতে, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মোট বাজেট থেকে দরিদ্র নয় এমন মানুষের হাতে যেসব সুবিধা যাচ্ছে, তা যদি বাদ দেওয়া হয়, তবে জিডিপির ১ শতাংশেরও কম যায় দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরে কাগজে কলমে তা জিডিপির ২ দশমিক ৮ শতাংশ। পিছিয়ে পড়া মানুষ, তা সে হোক ভূমিহীন, দুঃস্থ নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, সামাজিকভাবে অচ্ছুত, দরিদ্র অথবা হতদরিদ্র, বাজেটে এ ধরনের বরাদ্দ তাদের কারোরই কাম্য নয়।

হরিজন, প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত চা-শ্রমিক, হিজড়া, বেদে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতি ও পেশাগত সম্প্রদায় ও এই অঞ্চলের খাদ্য সহায়তা পায় এমন সব জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ৮ রকম সুবিধা বরাদ্দ আছে। এই বরাদ্দের পরিমাণ ২০২১-২০২২ সালে ১ হাজার ৩৮ কোটি টাকা, যা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাজেটের দশমিক ৯৩ শতাংশ। উপকারভোগীর প্রকৃত সংখ্যার তুলনায় এই বরাদ্দের পরিমাণ অনেক কম। তাই কিছু সাহায্য পেলেও তা মোটেও যথেষ্ট নয়। এসব জনগোষ্ঠীর মাঝে বিরাজমান দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ও আধুনিক দাসত্ব থেকে তাদের বের করে আনতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াতে হবে।

আধুনিক দাসত্বের জালে আটকে পড়া যৌনকর্মী, যারা প্রতিনিয়ত চরম সহিংসতা, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হন, তাদের জন্য বাজেটে আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। পুনর্বাসনসহ নিজেদের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য একটি আলাদা কর্মসূচির দাবি তাদের। এমন দাবি অযৌক্তিক নয়, বরং যথাযোগ্য বিবেচনায় নেওয়া উচিত। বাংলাদেশের ১১টি যৌনপল্লী, বিভিন্ন হোটেল, বাসা-বাড়ি ও রাস্তায় কর্মরত প্রায় ১ লাখ যৌনকর্মীর অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক। সন্তানদের শিক্ষার জন্যও প্রয়োজন সাহায্যের। এমন মানবেতর জীবনযাপন সত্ত্বেও তারা আমাদের সমাজের কারো বিবেচনায় আসেন না, থেকে যান নজরের বাইরে।

আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ভূমিহীন অথবা কার্যত ভূমিহীন। খাস জমি ও ভূমিহীন জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা যেসব তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছে, তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের মোট পরিবারের প্রায় ৭৭ শতাংশ হয় সম্পূর্ণ ভূমিহীন অথবা ভাড়া নিয়ে অন্যের জমি ব্যবহারকারী এবং ৫ শতাংশ ভূমির মালিকানা আছে এমন।

একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য সেখানকার দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূমির মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশে ৩৩ লাখের মতো সরকারি খাস জমি রয়েছে, যা ভূমিহীন মানুষের মাঝে বিতরণ করা সম্ভব। এর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে একটি আলাদা কার্যক্রম চালুর প্রস্তাবও ইতোমধ্যে সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে। এরকম বিশেষ কার্যক্রম দারিদ্র্য নিরসন কৌশলের আদর্শ হিসেবেও কাজ করতে পারে।

সামনের দিনগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে আরও কার্যকরী করে তোলার অনেক বড় দায়িত্ব এখন সরকারের। একদিকে সরকারকে যেমন এসব কর্মসূচির যথার্থ বাস্তবায়নে বিভিন্ন অনিয়ম দূর করতে হবে, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনসংখ্যার ওপর সুষ্ঠু তথ্যভাণ্ডার তৈরি এবং উপকারভোগীর একটি বাস্তব ও প্রকৃত তালিকা নির্ধারণ করতে হবে, এর পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের অবসর ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ— এই কার্যক্রমগুলো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে আলাদা করতে হবে, যেন প্রকৃত সুবিধাবঞ্চিত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি ও প্রাপ্ত ভাতার পরিমাণ সুষ্ঠুভাবে বৃদ্ধি পায়।

এই মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত প্রকৃত উপকারভোগীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর ব্যাপারে। এই উদ্দেশ্যে যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। কেবল তখনই বাংলাদেশের পক্ষে তার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রণয়নের যে মূল উদ্দেশ্য, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতি গড়ে তোলা, যার মাধ্যমে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে মানবিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের মানুষের কল্যাণ সাধন’, তা অর্জন করা সম্ভব হবে।

তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে লেখককে সাহায্য করেছেন ফাহমিদা আফরোজ নাদিয়া, মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও সাবরিনা মিতি গাইন।

ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের (সেড) পরিচালক

Philip.gain@gmail.com

চা-শ্রমিকদের ধর্মঘটের অবসান, তারপর

চা-শ্রমিকদের ধর্মঘটের অবসান, তারপর

রোববার, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২ ০২:৪২ অপরাহ্ন | মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের আন্দোলন। ছবি: সংগৃহীত/ফাইল ফটো

আগস্টের ৯-২৭ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগানগুলোয় শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘটের এক পর্যায়ে বাগান মালিক পক্ষ দৈনিক নগদ ১৪৫ টাকা মজুরি দিতে সম্মত হয়। এতে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বেড়ে যায়।

শ্রমিকরা মালিকদের সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থা (জেলা প্রশাসক, শ্রম অধিদপ্তর ও পুলিশ) এবং তাদের নেতাদের সিদ্ধান্ত, আদেশ ও অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন।

চা-বাগানের শ্রমিকরা ২৪ আগস্ট মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেন। ওইদিন মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশমন্ত্রী সেখানে গিয়ে শ্রমিকদেরকে আশ্বস্ত করেন যে শিগগির তাদের মজুরির বিষয় সমাধান করা হবে।

দৈনিক ৩০০ টাকার মজুরির দাবি পূরণ না হলে শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন না এমন শক্ত অবস্থানের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনাদের সঙ্গে শিগগির কথা বলবেন। মজুরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। আগামী ৩ দিনের মধ্যে মজুরি সমস্যার সমাধান হবে।’

গত ২৪ আগস্ট থেকে ৩ দিনের মাথায় ২৭ আগস্ট চা-বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে ২ ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চা-শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।

চা-শ্রমিকরা মজুরি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছিলেন এবং তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে কাজে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।

চা-শ্রমিকরা তাদের দাবির তুলনায় অনেক কম মজুরি পেলেন বটে। তবে একবারে ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি আগে কখনো ঘটেনি। বিটিএ ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (বিসিএসইউ) ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য কার্যকর মজুরি নির্ধারণ করে যে চুক্তিপত্র সই করে তাতে দৈনিক মজুরি বেড়েছিল ১৮ টাকা। ওই সময় পর্যন্ত ওটাই ছিল সর্বোচ্চ মজুরি বৃদ্ধি।

ভবিষ্যতে মজুরি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং তারা ন্যায্য মজুরি পাবেন—এমন আশা নিয়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরে গেছেন। চা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষসহ সব পক্ষ এখন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সময় পেল।

তবে ৯-২৭ আগস্ট চা-শ্রমিকরা যে সর্বাত্মক ধর্মঘট চালিয়েছেন তা যেন আবার না ঘটে তার জন্য অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। বুঝতে হবে কেন মজুরি বোর্ড ও মালিক-শ্রমিকপক্ষের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রম আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়ে পড়ে।

শ্রম আইনের ১৪০ক ধারায় সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই প্রধানমন্ত্রী সমাধানের কেন্দ্রে এসেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

শ্রম আইনে এ ধারায় আছে, ‘এই আইনের ধারা ১৩৯, ১৪০ ও ১৪২ এ যে বিধানই থাকুক না কেন, বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকার কোন শিল্প সেক্টরের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের যেকোনো পর্যায়ে নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার জন্য ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনরায় ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, এইরূপ ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন মনে করিলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা না করিয়া শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সহিত আলোচনাক্রমে চলমান মজুরি হারের কোন সংশোধন বা পরিবর্তন কার্যকর করিতে পারিবে।’

তবে শ্রম আইন মেনে প্লাকিং বোনাস (নিরিখের অধিক তোলা পাতার জন্য প্রদত্ত অর্থ), মাঠে ও কারখানায় বেশি সময় কাজের জন্য প্রদত্ত অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই মজুরির হিসাব করতে হবে।

মালিকদের মজুরির হিসাবে নগদ মজুরির বাইরে আরও যেসব সুবিধাকে অর্থে রূপান্তর করে মজুরির সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সেসবের অধিকাংশকে শ্রম আইনের ২ ধারার ৪৫ উপধারা অনুসারে মজুরির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

গত ৩০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে বিটিএর পক্ষ থেকে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয় তাতে বলা হয়েছে, মজুরি বৃদ্ধির পর একজন শ্রমিককে মালিক যা দিবে তা ‘গড়ে দৈনিক প্রায় ৫৪০ টাকা হয়’। এ হিসাব একেবারেই অযৌক্তিক!

নগদ মজুরির বাইরে অন্যান্য সুবিধার আর্থিক মূল্য নির্ধারণের জন্য বিটিএ, বিসিএসইউ এবং অন্য যারা জড়িত তারা ভারতের আসামে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মজুরির হিসাব দেখতে পারে।

আসামে গত ১ আগস্ট থেকে কার্যকর দৈনিক নগদ মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাগানগুলোর জন্য ২৩২ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ২১০ রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে।

দৈনিক নগদ মজুরির বাইরে আসামে একজন শ্রমিক যেসব ইন-কাইন্ড সুবিধা ও ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধা (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) পান তার পরিমাণ ১০৪ রুপি।

আসামের লেবার ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের নোটিফিকেশনে প্রকাশ করা হয়েছে এ হিসাব। নগদ মজুরির বাইরে যুক্ত এসব খাত হলো: রেশন (১৪ দশমিক ২০ রুপি), চিকিৎসা সুবিধা (১৬ দশমিক ৭৫ রুপি), আবাসন সুবিধা (১৫ দশমিক ২২ রুপি), জ্বালানি কাঠ (৫ দশমিক ৭৪ রুপি), কল্যাণ কর্মসূচি (৫ দশমিক ৬০ রুপি), শিক্ষা সুবিধা (২ দশমিক ৮৫ রুপি) ও চা (৩ দশমিক ৬৬ রুপি)।

দৈনিক ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধার (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) মধ্যে আছে এক্স-গ্রাসিয়া (২৫ দশমিক ০৩ রুপি) ও মজুরিসহ ছুটি এবং উৎসব ভাতা (১৪ দশমিক ৯৫ রুপি)। অর্থাৎ তাদের দৈনিক যৌগিক (কম্পোজিট) মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জন্য ৩৩৬ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ৩১৪ রুপি।

আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছি কারণ আসাম ও বাংলাদেশের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। আসাম ও বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের দাম প্রায় সমান।

বাংলাদেশের বিটিএ নগদ ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে মজুরির যে হিসাব দিয়েছে তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বিটিএর তথ্য অনুসারে চা-শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ কাজ করেন মাঠে এবং ১০ শতাংশ কারখানায়। মাঠে চা-শ্রমিকরা চা গাছ লাগান, সেগুলোকে বড় করেন, যত্ন নেন এবং নারী শ্রমিকরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিদিন দীর্ঘসময় ধরে চায়ের কচি পাতা তোলেন। সবুজ পাতা তোলার দৃশ্যই আমরা বেশি দেখি যা আমাদেরকে মুগ্ধ করে।

‘মালিকপক্ষ নগদ মজুরির ওপরে প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধার যে আর্থিক মূল্য হিসাবে এনেছে তা আমি প্রত্যাখ্যান করি,’ বলেন বিসিএসইউর নির্বাহী উপদেষ্টা ও মজুরি বোর্ডে চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য রামভজন কৈরি। তার পরামর্শ মালিক পক্ষকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে নগদ মজুরির বাইরে আর যা কিছু দিচ্ছে তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

‘মালিকপক্ষ এ পর্যন্ত যা করেছে তা তাদের ইচ্ছামত’ দাবি কৈরির। তিনি বলেন, ‘আসামে প্লাকিং বোনাস ও অধিকাল কাজের অর্থ মজুরির অন্তর্ভুক্ত নয়।’

মালিকপক্ষ কীভাবে ইচ্ছা মতো হিসাব করে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে ভর্তুকি মূল্যে ৪২ (২ টাকা কেজি দরে) আটা বা চাল পান। আমাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে বড়জোর ২০ কেজি চাল বা আটা পান।’

শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এডভোকেট নাসিম রামভজন কৈরির সমর্থনে বলেন, ‘শ্রমিকরা দৈনিক নগদ যা পান (১২০ টাকার সময়) তার সঙ্গে মালিক পক্ষ অন্যান্য সুবিধার ও সেবার আর্থিক মূল্য ইচ্ছা মতো যোগ করে বিভ্রান্তিকর হিসাব দিয়েছে। অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে প্লাকিং বোনাস, উৎসবভাতা, চিকিৎসা ও বার্ষিক ছুটি ভাতা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রশাসনিক ব্যয় মজুরির সঙ্গে যোগ করে মালিকপক্ষ আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’

তার মতে, ‘শ্রম আইন মানলে মালিকরা এসব “মূল মজুরি”র মধ্যে যোগ করতে পারে না।’

শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তারা এখন ১৭০ টাকা দৈনিক নগদ মজুরি পাবেন, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১২০ টাকা। অর্থাৎ নতুন মজুরি কাঠামো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে এ পর্যন্ত (আগস্ট ২০২২) ২০ মাস যে শ্রমিক পুরো সময় কাজ করেছেন তিনি সরলীকৃত হিসাবে (৫০ টাকা X ৩০ দিন X ২০ মাস) বকেয়া হিসাবে পাবেন ৩০ হাজার টাকা।

বিটিএ ও বিসিএসইউকে এখন জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সালের জন্য কার্যকর কর্মোত্তর (পোস্ট-ফ্যাক্টুম) চুক্তি সই করতে হবে এবং কয়েক দফায় শ্রমিকের বকেয়া শোধ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই হয়ে এসেছে।

বকেয়া পাওয়ার প্রশ্নে উদ্বেগের বিষয় হলো চা-বাগানগুলোয় এক লাখের মতো স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি ৪০ হাজারের মতো অস্থায়ী শ্রমিক বকেয়া পাবেন কি না। গত ২ বার চুক্তির সময়কালে (৪ বছর) অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) শ্রমিকরা স্থায়ী শ্রমিকদের সমান মজুরি পেয়ে আসছেন। তবে স্থায়ী শ্রমিকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পান তা তারা পান না।

রামভজন কৈরি বলেন, ‘সময়মতো যদি মালিক-শ্রমিকের চুক্তিপত্র সই হতো তাহলে অস্থায়ী শ্রমিকরা প্রথম থেকেই বর্ধিত হারে মজুরি পেতেন। কাজেই অস্থায়ী চা-শ্রমিকদেরকে বকেয়া দেওয়ার প্রথা এখনই শুরু করা দরকার।’

গত আগস্টে আমরা যা দেখলাম তা চা-বাগানে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় সূচনা করল। চা-শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা, তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করেছেন। মজুরির ব্যাপারে মূল দাবির আংশিক পূরণ হলেও তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে কাজে ফিরে গেছেন। এরপরও যা ঘটেছে তাকে চা-শ্রমিকদের নীরব বিদ্রোহেরই বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

স্মরণে রাখতে হবে যে চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন ৫ প্রজন্ম ধরে চা-বাগানে আটকে আছেন। তারা যে জমিতে বাস করেন এবং যে জমিতে তারা কাজ করেন ও চাষ করেন সে জমির মালিক তারা নন। তারা যে ঘরে বাস করেন, সে ঘরেরও মালিক তারা নন। কাজেই মজুরি ছাড়াও তারা আরও গুরুতর বিষয় তুলতে পারেন, আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন।

আমরা আশা করব, বর্তমান ২ বছরের চুক্তির মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পর অতীতের মতো ভবিষ্যতে বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে দরকষাকষি আটকে থাকবে না। সময় মতো চুক্তি সম্পাদন ও যুক্তিসঙ্গত মজুরি নির্ধারণই চা-বাগানে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করবে।

ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের পরিচালক।

চা-শ্রমিকদের ধর্মঘটের অবসান, তারপর

Tea workers’ strike ends. What’s next?

By Philip Gain, The Daily Star, Sep 3, 2022 | Bangla Edition | English Edition
Tea garden workers show three fingers in tune to their demand for Tk 300 in cash wage. Photo: Philip Gain

During an unprecedented strike between August 9 and 27, the tea workers in northeastern Bangladesh demanded a cash pay of Tk 300 per day. The tea garden owners agreed to raise the wage to Tk 145 per day, which enraged the workers. In defiance of the owners’ decision, government officials and agencies (DCs, Department of Labour and police) and their own leaders, the tea workers continued their strike till August 27.

They began to cool down when Environment Minister Md Shahab Uddin, who is an MP from Moulvibazar-1 constituency, visited a blockade on the Moulvibazar-Barlekha regional highway on August 24 and assured the protesting tea workers that their wage issue would be settled soon. Responding to the workers’ firm position that they would not go back to work until their demand for Tk 300 in daily wage was met, the minister said, “The prime minister will talk to you on [the] wage issue and make a decision. The matter will be solved in three days.”

Three days later, on August 27, Prime Minister Sheikh Hasina sat with the tea garden owners’ apex body, Bangladesh Tea Association (BTA), and fixed the daily cash wage at Tk 170. The tea workers wanted the PM to interfere and promised to accept what she would decide for them.

Although what they had demanded originally was more than what they got, never before in history have these tea workers seen an increase of Tk 50 at one go. In an agreement between the BTA and Bangladesh Cha Sramik Union (BCSU), the lone trade union and combined bargaining agent of tea workers, the increase was Tk 18 for 2019 and 2020 – the maximum till then.

The workers have gone back to work now with hopes that their expectation for just wages would be met in the future. All parties, including the workers’ union and the owners’ association, now have breathing space and time to build faith in each other.

However, there are other burning issues to be discussed at length and understood so that the workers do not have to resort to such strikes again. The PM had to interfere when the Minimum Wage Board and the negotiation between BTA and BCSU failed completely. She has understandably acted upon a special power given to the government by Section 140(A) of the Labour Act to bring an end to the strike.

However, the calculation of wages, including the plucking bonus, overtime payment for work in the field and factories, and fringe benefits, should be done taking the labour law into consideration. The sub-section 45 of Section 2 of the Labour Act does not allow inclusion of most of the facilities/items that the owners monetise in their calculations of what they give to the workers in addition to the cash wage. In a press conference on August 30, BTA leaders claimed that, after the increase in wages, what they would now give to a tea worker would be nearly Tk 540 per day! But such calculations are absurd.

To be pragmatic about calculating the cash components of fringe benefits, BTA, BCSU and other parties involved may check the calculation from our neighbour, Assam, wherein the calculation of wages is acceptable to all parties. In Assam, the daily cash wage was fixed at Rs 232 for Brahmaputra Valley and Rs 210 in Barak Valley, effective from August 1.

The Labour Welfare Department of Assam has also published the cash component of wages paid in kind and the rate of compensatory benefits per day, which stand at Rs 104. Thus, the composite wages for workers per day in Brahmaputra Valley are Rs 336 and Rs 314. I mention the situation of wages in Assam because of the similarity between Assam and Bangladesh.

BTA’s calculation of what a worker gets comes as a big surprise to workers and their union. According to the BTA, 90 percent of the workers work in the field planting tea, taking care of the plantations, and plucking tea leaves. While those working in the field will now get Tk 170 in daily cash pay, those working in the factory (10 percent of the workers) will get little more. Then, the owners have added 17 other components which are paid in cash and kind. BTA has not consulted the workers’ union at all in this calculation of wages. Many of the components have been included in violation of the labour law. Those that merit as cash components paid in kind are also overestimates.

“I reject the owners’ calculation of wages,” says Rambhajan Kairi, executive advisor of BCSU and a member of the Minimum Wage Board to represent tea workers. Kairi suggests that the owners should sit with BCSU to jointly calculate the cash component of the wages paid in kind. “What the owners have done so far is just arbitrary,” he asserts. “In Assam, the plucking bonus and overtime are not added to wages.”

Advocate AKM Nasim, country programme director of Solidarity Centre, which works for workers’ rights, has argued in support of Rambhajan Kairi. “Tea garden owners presented a misleading calculation of cash wages and the in-kind services they provided to tea workers when the daily cash wage was Tk 120. The employers’ calculation confuses us when they include plucking bonuses, festival bonuses, medical and annual leave benefits and provident fund’s administrative expenses, among others, within the definition of wages,” Nasim said. “The Labour Act does not allow the owners to add these as ‘basic wage.'”

Now that the tea workers have gone back to work, they will start getting a daily cash wage of Tk 170, which was previously Tk 120. This means the new wage structure would have gone into effect from January 2021. So, from then to date (end of August 2022) there are 20 months for which a worker who has worked all work days during this period will get an arrear of around Tk 30,000 at a simplified calculation (Tk 50x30x20). A post-factum agreement (effective from January 2021 to December 2022) will now be signed between BTA and BCSU, as it happened in the past to facilitate the payment of arrears in instalments.

One concern is if 40,000 casual tea workers will get the arrears or not. According to media reports quoting the secretary of BTA, only the registered workers will get the arrears. The casual workers have been getting the same cash wages for the last two agreement periods (four years) as the registered workers. They do not get equal fringe benefits, however. “Had the agreement been signed in time, the casual workers would get the increased wages,” argues Rambhajan Kairi. “Therefore, the practice of paying arrears to the casual workers should start from now on.”

What we have witnessed in August begins a new era of protest in the tea gardens. The tea workers have demonstrated the strength of their united voice. They have gone back to work with their key demand only partially fulfilled. Yet, it is seen as a victory of the tea workers’ quiet revolt.

What we should not forget is that these workers and their communities have remained tied to the tea gardens for five generations. They don’t own the land that they till and live on. The houses they live in are not theirs, either. There are issues other than wages they can raise, leading to a bigger movement. For now, we would expect that negotiations and an agreement between the BCSU and BTA are not stalled like in the past, after the current two-year agreement period ends in December 2022. A timely agreement and reasonable increase in wages will bring lasting peace in the tea gardens.

Philip Gain is a researcher and director at the Society for Environment and Human Development (SEHD).

Bangla edition:

চা-শ্রমিকদের ধর্মঘটের অবসান, তারপর

আগস্টের ৯-২৭ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগানগুলোয় শ্রমিকরা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন। ধর্মঘটের এক পর্যায়ে বাগান মালিক পক্ষ দৈনিক নগদ ১৪৫ টাকা মজুরি দিতে সম্মত হয়। এতে শ্রমিক অসন্তোষ আরও বেড়ে যায়।

শ্রমিকরা মালিকদের সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও সংস্থা (জেলা প্রশাসক, শ্রম অধিদপ্তর ও পুলিশ) এবং তাদের নেতাদের সিদ্ধান্ত, আদেশ ও অনুরোধ উপেক্ষা করে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন।

চা-বাগানের শ্রমিকরা ২৪ আগস্ট মৌলভীবাজার-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়ক কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেন। ওইদিন মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশমন্ত্রী সেখানে গিয়ে শ্রমিকদেরকে আশ্বস্ত করেন যে শিগগির তাদের মজুরির বিষয় সমাধান করা হবে।

দৈনিক ৩০০ টাকার মজুরির দাবি পূরণ না হলে শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন না এমন শক্ত অবস্থানের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আপনাদের সঙ্গে শিগগির কথা বলবেন। মজুরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। আগামী ৩ দিনের মধ্যে মজুরি সমস্যার সমাধান হবে।’

গত ২৪ আগস্ট থেকে ৩ দিনের মাথায় ২৭ আগস্ট চা-বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) প্রতিনিধিদের সঙ্গে ২ ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী চা-শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন।

চা-শ্রমিকরা মজুরি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছিলেন এবং তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে কাজে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।

চা-শ্রমিকরা তাদের দাবির তুলনায় অনেক কম মজুরি পেলেন বটে। তবে একবারে ৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি আগে কখনো ঘটেনি। বিটিএ ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (বিসিএসইউ) ২০১৯ ও ২০২০ সালের জন্য কার্যকর মজুরি নির্ধারণ করে যে চুক্তিপত্র সই করে তাতে দৈনিক মজুরি বেড়েছিল ১৮ টাকা। ওই সময় পর্যন্ত ওটাই ছিল সর্বোচ্চ মজুরি বৃদ্ধি।

ভবিষ্যতে মজুরি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং তারা ন্যায্য মজুরি পাবেন—এমন আশা নিয়ে শ্রমিকরা কাজে ফিরে গেছেন। চা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন ও মালিকপক্ষসহ সব পক্ষ এখন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের সময় পেল।

তবে ৯-২৭ আগস্ট চা-শ্রমিকরা যে সর্বাত্মক ধর্মঘট চালিয়েছেন তা যেন আবার না ঘটে তার জন্য অনেক বিষয় আছে যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। বুঝতে হবে কেন মজুরি বোর্ড ও মালিক-শ্রমিকপক্ষের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রম আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ অবধারিত হয়ে পড়ে।

শ্রম আইনের ১৪০ক ধারায় সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই প্রধানমন্ত্রী সমাধানের কেন্দ্রে এসেছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

শ্রম আইনে এ ধারায় আছে, ‘এই আইনের ধারা ১৩৯, ১৪০ ও ১৪২ এ যে বিধানই থাকুক না কেন, বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকার কোন শিল্প সেক্টরের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের যেকোনো পর্যায়ে নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার জন্য ন্যূনতম মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনরায় ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা করিতে পারিবে। তবে শর্ত থাকে যে, এইরূপ ক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজন মনে করিলে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নতুনভাবে ন্যূনতম মজুরি হার ঘোষণা না করিয়া শ্রমিক ও মালিকপক্ষের সহিত আলোচনাক্রমে চলমান মজুরি হারের কোন সংশোধন বা পরিবর্তন কার্যকর করিতে পারিবে।’

তবে শ্রম আইন মেনে প্লাকিং বোনাস (নিরিখের অধিক তোলা পাতার জন্য প্রদত্ত অর্থ), মাঠে ও কারখানায় বেশি সময় কাজের জন্য প্রদত্ত অর্থ ও অন্যান্য সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই মজুরির হিসাব করতে হবে।

মালিকদের মজুরির হিসাবে নগদ মজুরির বাইরে আরও যেসব সুবিধাকে অর্থে রূপান্তর করে মজুরির সঙ্গে যোগ করা হয়েছে সেসবের অধিকাংশকে শ্রম আইনের ২ ধারার ৪৫ উপধারা অনুসারে মজুরির অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

গত ৩০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে বিটিএর পক্ষ থেকে যে লিখিত বক্তব্য দেওয়া হয় তাতে বলা হয়েছে, মজুরি বৃদ্ধির পর একজন শ্রমিককে মালিক যা দিবে তা ‘গড়ে দৈনিক প্রায় ৫৪০ টাকা হয়’। এ হিসাব একেবারেই অযৌক্তিক!

নগদ মজুরির বাইরে অন্যান্য সুবিধার আর্থিক মূল্য নির্ধারণের জন্য বিটিএ, বিসিএসইউ এবং অন্য যারা জড়িত তারা ভারতের আসামে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মজুরির হিসাব দেখতে পারে।

আসামে গত ১ আগস্ট থেকে কার্যকর দৈনিক নগদ মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাগানগুলোর জন্য ২৩২ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ২১০ রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে।

দৈনিক নগদ মজুরির বাইরে আসামে একজন শ্রমিক যেসব ইন-কাইন্ড সুবিধা ও ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধা (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) পান তার পরিমাণ ১০৪ রুপি।

আসামের লেবার ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টের নোটিফিকেশনে প্রকাশ করা হয়েছে এ হিসাব। নগদ মজুরির বাইরে যুক্ত এসব খাত হলো: রেশন (১৪ দশমিক ২০ রুপি), চিকিৎসা সুবিধা (১৬ দশমিক ৭৫ রুপি), আবাসন সুবিধা (১৫ দশমিক ২২ রুপি), জ্বালানি কাঠ (৫ দশমিক ৭৪ রুপি), কল্যাণ কর্মসূচি (৫ দশমিক ৬০ রুপি), শিক্ষা সুবিধা (২ দশমিক ৮৫ রুপি) ও চা (৩ দশমিক ৬৬ রুপি)।

দৈনিক ক্ষতিপূরণমূলক সুবিধার (কনপেনসেন্টরি বেনিফিট) মধ্যে আছে এক্স-গ্রাসিয়া (২৫ দশমিক ০৩ রুপি) ও মজুরিসহ ছুটি এবং উৎসব ভাতা (১৪ দশমিক ৯৫ রুপি)। অর্থাৎ তাদের দৈনিক যৌগিক (কম্পোজিট) মজুরি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার জন্য ৩৩৬ রুপি ও বরাক উপত্যকার জন্য ৩১৪ রুপি।

আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছি কারণ আসাম ও বাংলাদেশের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। আসাম ও বাংলাদেশে উৎপাদিত চায়ের দাম প্রায় সমান।

বাংলাদেশের বিটিএ নগদ ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে মজুরির যে হিসাব দিয়েছে তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। বিটিএর তথ্য অনুসারে চা-শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ কাজ করেন মাঠে এবং ১০ শতাংশ কারখানায়। মাঠে চা-শ্রমিকরা চা গাছ লাগান, সেগুলোকে বড় করেন, যত্ন নেন এবং নারী শ্রমিকরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রতিদিন দীর্ঘসময় ধরে চায়ের কচি পাতা তোলেন। সবুজ পাতা তোলার দৃশ্যই আমরা বেশি দেখি যা আমাদেরকে মুগ্ধ করে।

‘মালিকপক্ষ নগদ মজুরির ওপরে প্রদত্ত অন্যান্য সুবিধার যে আর্থিক মূল্য হিসাবে এনেছে তা আমি প্রত্যাখ্যান করি,’ বলেন বিসিএসইউর নির্বাহী উপদেষ্টা ও মজুরি বোর্ডে চা-শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সদস্য রামভজন কৈরি। তার পরামর্শ মালিক পক্ষকে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে নগদ মজুরির বাইরে আর যা কিছু দিচ্ছে তার আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

‘মালিকপক্ষ এ পর্যন্ত যা করেছে তা তাদের ইচ্ছামত’ দাবি কৈরির। তিনি বলেন, ‘আসামে প্লাকিং বোনাস ও অধিকাল কাজের অর্থ মজুরির অন্তর্ভুক্ত নয়।’

মালিকপক্ষ কীভাবে ইচ্ছা মতো হিসাব করে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে ভর্তুকি মূল্যে ৪২ (২ টাকা কেজি দরে) আটা বা চাল পান। আমাদের হিসাবে একজন শ্রমিক মাসে বড়জোর ২০ কেজি চাল বা আটা পান।’

শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত সলিডারিটি সেন্টারের কান্ট্রি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এডভোকেট নাসিম রামভজন কৈরির সমর্থনে বলেন, ‘শ্রমিকরা দৈনিক নগদ যা পান (১২০ টাকার সময়) তার সঙ্গে মালিক পক্ষ অন্যান্য সুবিধার ও সেবার আর্থিক মূল্য ইচ্ছা মতো যোগ করে বিভ্রান্তিকর হিসাব দিয়েছে। অন্যান্য সুবিধার সঙ্গে প্লাকিং বোনাস, উৎসবভাতা, চিকিৎসা ও বার্ষিক ছুটি ভাতা ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রশাসনিক ব্যয় মজুরির সঙ্গে যোগ করে মালিকপক্ষ আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে।’

তার মতে, ‘শ্রম আইন মানলে মালিকরা এসব “মূল মজুরি”র মধ্যে যোগ করতে পারে না।’

শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তারা এখন ১৭০ টাকা দৈনিক নগদ মজুরি পাবেন, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল ১২০ টাকা। অর্থাৎ নতুন মজুরি কাঠামো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তখন থেকে এ পর্যন্ত (আগস্ট ২০২২) ২০ মাস যে শ্রমিক পুরো সময় কাজ করেছেন তিনি সরলীকৃত হিসাবে (৫০ টাকা X ৩০ দিন X ২০ মাস) বকেয়া হিসাবে পাবেন ৩০ হাজার টাকা।

বিটিএ ও বিসিএসইউকে এখন জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ সালের জন্য কার্যকর কর্মোত্তর (পোস্ট-ফ্যাক্টুম) চুক্তি সই করতে হবে এবং কয়েক দফায় শ্রমিকের বকেয়া শোধ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে এমনটাই হয়ে এসেছে।

বকেয়া পাওয়ার প্রশ্নে উদ্বেগের বিষয় হলো চা-বাগানগুলোয় এক লাখের মতো স্থায়ী শ্রমিকের পাশাপাশি ৪০ হাজারের মতো অস্থায়ী শ্রমিক বকেয়া পাবেন কি না। গত ২ বার চুক্তির সময়কালে (৪ বছর) অস্থায়ী (ক্যাজুয়াল) শ্রমিকরা স্থায়ী শ্রমিকদের সমান মজুরি পেয়ে আসছেন। তবে স্থায়ী শ্রমিকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পান তা তারা পান না।

রামভজন কৈরি বলেন, ‘সময়মতো যদি মালিক-শ্রমিকের চুক্তিপত্র সই হতো তাহলে অস্থায়ী শ্রমিকরা প্রথম থেকেই বর্ধিত হারে মজুরি পেতেন। কাজেই অস্থায়ী চা-শ্রমিকদেরকে বকেয়া দেওয়ার প্রথা এখনই শুরু করা দরকার।’

গত আগস্টে আমরা যা দেখলাম তা চা-বাগানে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় সূচনা করল। চা-শ্রমিকরা, বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা, তাদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শন করেছেন। মজুরির ব্যাপারে মূল দাবির আংশিক পূরণ হলেও তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে কাজে ফিরে গেছেন। এরপরও যা ঘটেছে তাকে চা-শ্রমিকদের নীরব বিদ্রোহেরই বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।

স্মরণে রাখতে হবে যে চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন ৫ প্রজন্ম ধরে চা-বাগানে আটকে আছেন। তারা যে জমিতে বাস করেন এবং যে জমিতে তারা কাজ করেন ও চাষ করেন সে জমির মালিক তারা নন। তারা যে ঘরে বাস করেন, সে ঘরেরও মালিক তারা নন। কাজেই মজুরি ছাড়াও তারা আরও গুরুতর বিষয় তুলতে পারেন, আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন।

আমরা আশা করব, বর্তমান ২ বছরের চুক্তির মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পর অতীতের মতো ভবিষ্যতে বিটিএ ও বিসিএসইউর মধ্যে দরকষাকষি আটকে থাকবে না। সময় মতো চুক্তি সম্পাদন ও যুক্তিসঙ্গত মজুরি নির্ধারণই চা-বাগানে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করবে।

ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্টের পরিচালক।