“সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি আরো আছে নারী ও মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা, যা সহিংসতার আরেকটি মাত্রা। এসবের যারা শিকার তাদের কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনার মানুষের সংখ্যা অনেক কম বাংলাদেশে। এই শোনার জায়গাটা তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
নারীর প্রতি সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সহিংসতা বিষয়ে এভাবেই মতামত তুলে ধরেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ও ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার (বিআরসি)-এর গবেষণা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিআরসি, সোসাইটি ফর এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), পিপিআরসি ও সহযোগী সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ৩০ নভেম্বর ২০২২ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে ড. রহমান মত ব্যক্ত করেন। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের প্রচারাভিযান উদযাপন উপলক্ষে এই আলোচনা সভা ও এর সাথে ট্রান্সজেন্ডার সাংস্কৃতিক দলের একটি মনোজ্ঞ পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।
যৌনকর্মী (যৌনপল্লী, রাস্তা ও হোটেলে কর্মরত), হিজড়া (ট্রান্সজেন্ডার), নারী চা শ্রমিক, বেদে নারী, মানবাধিকার কর্মী ও মহিলা সাংবাদিকসহ প্রায় ৮০ জন প্রতিনিধি নারীর প্রতি সংহতি প্রদর্শনপূর্বক এই সভায় মিলিত হন। এই প্রচারাভিযান বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদযাপিত হয় এবং ২০২২ সালে-এর মূল সুর ছিল ‘এক হও! নারী ও কন্যার উপর সহিংসতা বন্ধে প্রচারাভিযান’।
আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে সেড’র পরিচালক ফিলিপ গাইন নারী চা শ্রমিক, যৌনকর্মী, হিজড়া, আদিবাসী নারী এবং বেদে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের সহিংসতা এবং তাদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেন।
আলোচনা সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, চরম বৈষম্য ও বঞ্চনা ইত্যাদির শিকার নারীদের কণ্ঠস্বর সামনে নিয়ে আসা।
মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত শমশেরনগর চা বাগানের একজন শিক্ষিকা ২০১৫ সালে গণ-ধর্ষণের শিকার হন। তিনি তার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, “ধর্ষণের ঘটনা প্রথমে গোপন রাখার চেষ্টা করেছি, আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি। পরবর্তীতে আমি আমার পরিবার এবং ডাক্তারকে ঘটনা খুলে বলি এবং ন্যায়বিচারের আশায় মামলা করি। কিন্তু মামলা করেও আজ পর্যন্ত আমি ন্যায়বিচার পাইনি। মামলার আসামীরা আজ জামিন নিয়ে জেলের বাইরে। তারপরও, এখনো আমি ন্যায় বিচার ও আসামীর শাস্তি হোক এটাই চাই।”
ট্রান্সজেন্ডার নারী অধিকার কর্মী জয়া সিকদার হিজড়াদেও অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি তাদের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, “হিজড়া একটি পেশা বা সংস্কৃতি, এটা কোনো লৈঙ্গিক পরিচয় নয়। লৈঙ্গিক পরিচয়ের এই জায়গাটা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত।”
বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনি ত্রিপুরা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এফআইআর করতে গেলে ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক তথ্য এদিক-ওদিক হয়ে যায়, ঠিকভাবে নথিভুক্ত হয় না। গোঁড়াতেই এমন গÐগোল হলে ন্যায়বিচারের আশা কীভাবে করা যায়!”
দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা লিলি বেগম গত ১০ নভেম্বর ২০২১ থেকে নিখোঁজ। এখন পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠ তদন্ত বা আদালতে কোনো বিচার হলো না। আমরা জানতে চাই লিলি কি বেঁচে আছে কি না,” কাঁদতে কাঁদতে বলেন দৌলতদিয়া থেকে আসা কুমলি নামের এক যৌনকর্মী। পদ্মার পাড়ে রাজবাড়ী জেলায় অবস্থিত দৌলতদিয়া বাংলাদেশের ১১টি যৌনপ্ললীর মাঝে সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম যৌনপল্লীর একটি যেখানে প্রায় ১৪০০ জন যৌনকর্মীর অবস্থান। প্রায়শই হত্যাকান্ডসহ চরম সহিংসতার ঘটনা ঘটে এই পল্লীতে।
সভায় অন্যান্য যারা নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন তারা হলেন শিশুদের জন্য আমরা’র সভাপতি হাজেরা বেগম (প্রতিষ্ঠানটি যৌনকর্মীর সন্তান ও পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করে), সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি আলেয়া আক্তার লিলি, বৈকন্ঠপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক মনি কল (বাগানের ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার) ও বেদে নারী তিতনা খাতুন।
উপস্থিত বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নেতৃ, আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মূল কারণগুলো সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন। পাশাপাশি এ ধরনের সহিংসতার শিকার নারীদের সাহায্য প্রদানে, বিশেষ করে আইনি সহায়তা প্রদানে, তারা প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন।
বিষেশ অতিথি বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “একজন যৌনকর্মীর ধর্ষণের মামলা করার পূর্ণ অধিকার আছে, তার অভিযোগ লিখতে পুলিশ বাধ্য।”
অ্যাডভোকেট আলী আরো বলেন, “আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে প্রতিদিন, শুধু বছরের এই ষোলো দিন না। আমাদের আরো কাজ করতে হবে, প্রতিরোধ আরো দৃশ্যমান করে তুলতে হবে।”
একাত্তর টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রধান মিথিলা ফারজানা সহিংসতার শিকার নারীদের গল্প সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছানোর বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, “নারীদের সহিংসতা নিয়ে আমাদের গল্প অনেক, কিন্তু শুনছে অনেক কম মানুষ। গল্প উপস্থাপনের কৌশল জানতে হবে, পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে হবে। গল্পগুলো শুধু আমরা নারীরা শুনলেই হবে না, পুরুষদেরও জানতে হবে নারীর সংগ্রামের কথা। মিডিয়ার মাধ্যমে এই গল্পগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।”
মিথিলা ফারজানার এই বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু। “আমাদের এখন যা প্রয়োজন তা হলো একতা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। পুরুষকেও এই আন্দোলনে নিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে অধিকার আদায়ে আরো সোচ্চার হতে হবে,” বলেন মিস মিনু।
“একজন ধর্ষণের শিকার নারীকেই কেন প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন,” প্রশ্ন তুলেন মিনু। “বরং অপরাধীকে প্রমাণ করতে হবে যে সে নিরপরাধ।”
নারীর নিজের গল্প নিজে বলা ও তা নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ড. রহমান বলেন, “নিজের গল্পগুলো বলতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নারীকণ্ঠকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এর সাথে হতে হবে কৌশলী। সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে কোথায়, কখন ও কীভাবে নিজের কথা বলতে হবে তার কৌশল রপ্ত করাটা খুব জরুরী।”
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম ও আদিবাসী নারী কর্মী তন্দ্রা চাকমা।
হিজড়া সাংস্কৃতিক দলের মনোজ্ঞ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সভায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা পাঠ ও ছোট নাটিকার মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার শিল্পীরা নিজেদের প্রতিভা উপস্থাপনের পাশাপাশি সকল নারীর কাছে একটি সুন্দর বার্তা পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করেন—পেশা ও সহিংসতা যে ধরনেরই হোক না কেন, সকল নারী শক্তিশালী, প্রত্যেকের নিজস্ব প্রতিভা আছে, আছে সম্ভাবনা। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ নারী যেকোন সহিংসতা প্রতিরোধে সক্ষম। বার্তাটি প্রচারাভিযানের এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘এক হও! নারী ও কন্যার উপর সহিংসতা বন্ধে প্রচারাভিযান’ এরই একটি প্রতিফলন।