চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মৌলভীবাজার শহরের এক প্রাইভেট চেম্বারে তার জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন থেকে তার মৃত্যুর দিন গণনা শুরু। তবে ব্যথা নিয়েও তিনি বাগানে চা পাতা তোলার কষ্টের কাজ অব্যাহত রাখেন। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি সবশেষ কাজে যান। তার ৩ দিন পর ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি বিছানায় পড়েন। সেই দিন থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেননি।
ফিলিপ গাইন
বুধবার মার্চ ৮, ২০২৩ ০৩:৩০ অপরাহ্ন সর্বশেষ আপডেট: বুধবার মার্চ ৮, ২০২৩ ০৩:৩১ অপরাহ্ন
চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি
ছবি: সংগৃহীত
শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক রামদুলারী কৈরি ২০২১ সালের ২৮ মে ৪৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে খুব যন্ত্রণা ভোগ করেন।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মৌলভীবাজার শহরের এক প্রাইভেট চেম্বারে তার জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন থেকে তার মৃত্যুর দিন গণনা শুরু। তবে ব্যথা নিয়েও তিনি বাগানে চা পাতা তোলার কষ্টের কাজ অব্যাহত রাখেন। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি সবশেষ কাজে যান। তার ৩ দিন পর ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি বিছানায় পড়েন। সেই দিন থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেননি।
রামদুলারীর ছেলে বাবুল কৈরি (২৭) মায়ের দেখাশোনা করেন এবং তার চিকিৎসার জন্য দেড় লাখের মতো টাকা খরচ করেন। একটি চা শ্রমিক পরিবারের জন্য এটা বড় অংকের টাকা। ‘মাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। তাকে ১০টি কেমোথেরাপি দিয়েছি’, বলেন বাবুল। ‘মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে মায়ের জবান বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তার খুবই শ্বাসকষ্ট ছিল।’
বাবুল মাকে নিয়ে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন চা বাগানের নারীরা জরায়ুর ক্যানসারের ব্যাপারে মুখ খোলেন না। ক্যানসার যখন শেষের দিকে চলে আসে, তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া কাজ হয় না। ‘ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। বাগান ব্যবস্থাপনা এ খরচ বহন করতে নারাজ। ক্যানসার বা অন্য কোনো কঠিন রোগ হলে রোগী ও তার পরিবারকেই সব খরচ বহন করতে হয়’, আক্ষেপ করে বলেন বাবুল।
‘চা শ্রমিকরা সাধারণত জরায়ু এবং স্তন ক্যানসারের ব্যাপারে অসচেতন এবং অজ্ঞ’, বলেন ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন (আইপিএইচএন)-এর ডিভিশন চিফ, ডা. জয়নাল আবেদিন। তিনি ২০২১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
ডা. আবেদিন বলেন এই মারাত্মক অসুখ থেকে সুরক্ষার জন্য স্ক্রিনিং প্রয়োজন; যার ব্যবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে। চা বাগানগুলোতে জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে এসিটিক অ্যাসিড দিয়ে চাক্ষুষ পরিদর্শনের জন্য ক্যাম্প করা হয়। ‘আমরা চাক্ষুষ পরিদর্শনের সময় ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে পজিটিভ পাই’, জানান ডা. আবেদিন। এদেরকে নিশ্চিতকরণ (কনফার্মেটরি) পরীক্ষার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
‘বা চাগানে নারীদের জরায়ুর ক্যানসার থেকে রক্ষা করতে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার এবং এ ব্যাপারে চা বাগান ব্যবস্থাপনা এবং চা শ্রমিকদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে’, পরামর্শ ডা. আবেদিনের। প্রসূতি (অবস্টেট্রিক) ফিসটুলা—ভেসিকো-যোনি ফিস্টুলা (ভিডিএফ) এবং রেক্টো-যোনি ফিস্টুলা যা প্রধানত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের দরিদ্র নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়—বাংলাদেশে, বিশেষ করে চা বাগানে নারীদের মধ্যে একটি উদ্বেগের বিষয়। অল্প বয়সে যেসব মেয়ের বিয়ে হয়, ফিস্টুলায় তাদের বেশি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য শারীকিভাবে প্রস্তুত হবার আগেই তারা গর্ভধারণ করেন এবং সন্তান প্রসব করেন। এর ফলে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় জটিলতা দেখা দেয় এবং তাদের ফিস্টুলা হবার ঝুঁকি থাকে। আবার যাদের ফিস্টুলা হয় তাদের মধ্যে এ রোগের কথা প্রকাশ না করার প্রবণতা আছে।
ইউএনএফপিএ’র অর্থায়নে ও সরকারের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে ইনজুরি প্রতিরোধ ও গবেষণা সেন্টার (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজার জেলার ১০টি চা বাগানে এক গবেষণায় ২০ জন নারীকে ফিস্টুলা থাকতে পারে বলে চিহ্নিত করে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে এদের মধ্য থেকে ১৪ জন পজিটিভ (ইতিবাচক) চিহ্নিত করা হয়। এবং তাদেরকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তাদের মধ্য থেকে ৫ জনকে পাওয়া যায় যারা নিশ্চিতভাবে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের সবার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়স হবার আগে এবং তারা সবাই বিয়ে হবার এক বছরের মধ্যে গর্ভবতী হন। ফিস্টুলায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াকেই একটি বড় কারণ হিসাবে দেখা হয়। এ রোগের অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম বাড়িতে প্রশিক্ষণহীন ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব এবং প্রসবে দীর্ঘ বিলম্ব।
ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারী শারীরিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হন। সারাক্ষণ প্রস্রাব এবং পূঁজ বের হওয়ায় ক্ষতস্থান ভেজা থাকে এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়। ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারী অপমানিত হন, স্বামী পরিত্যক্ত হতে পারেন, সমাজে নিগ্রহের শিকার হন এবং সহিংসতারও শিকার হন। চা বাগানে যে ৫ জন নারীর ফিস্টুলায় আক্রান্ত হবার কথা উপরে বলা হয়েছে তারা সবাই প্রথম দিকে আক্রান্ত হবার কথা লুকিয়েছে, তাদের অসুবিধার কথা আমলে নেয়নি এবং ভেবেছে এমনিতে ক্ষত শুকিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। কেবলমাত্র সঠিক অস্ত্রোপচারই এ রোগের সঠিক নিরাময় করতে পারে।
সিআইপিআরবি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, ইউএনএফপিএ-এর আর্থিক সহায়তায় এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিআইপিআরবিকে সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৯ সালে সিলেট ডিভিশনে ফিস্টুলা নির্মূলের এক কর্মসূচি হাতে নেয়। এ কর্মসূচির আওতায় চা বাগানে ৩৪ জন ফিস্টুলা রোগী চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। অস্ত্রোপচারের পর এদের মধ্যে ২১ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরেন। ২০২২ সালে ১৯টি বাগানকে ফিস্টুলামুক্ত ঘোষণা করা হয়।
চা বাগানে জরায়ুর ক্যানসার এবং ফিস্টুলা নিয়ে গবেষণাভিত্তিক তথ্য খুব কম এবং মারাত্মক এ ব্যাধি দুটো সম্পর্কে মানুষ খুব কম জানে। কিন্তু চা বাগানে আরও প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে যা সর্বত্র উদ্বেগের কারণ। বর্তমান অবস্থায় সেসব ঝুঁকি সামলানো চ্যালেঞ্জিংও বটে।
এসব ঝুঁকির মধ্যে গর্ভপাত, মৃতসন্তান প্রসব এবং মাতৃমৃত্যু অন্যতম। বিশেষ করে নারী পাতাতোলা শ্রমিকরা দীর্ঘসময় কাজ করেন। পাতাতোলার সেকশনে যাতায়াতে দীর্ঘপথ হাটেন এবং তারা সারাদিন দাঁড়িয়ে কাজ করেন। গর্ভবতী নারীরা সন্তান জন্মদানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করেন এবং তারা নানা প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েন। জাগছড়া চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক অনিকা মুন্ডা এমন স্বাস্থ্যঝুঁকির একজন উপযুক্ত উদাহরণ।
গর্ভধারণের ৭ মাসের মাথায় ১৬ নভেম্বর ২০১৮, অনিকা মুন্ডা একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন। তার আগের দিন পাতা তোলার পর বাড়ি ফেরার পথে তিনি ৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটেছেন। তারপর তার তলপেটে ব্যথা অনুভব করেন। আনিকার শাশুড়ি তারামনি মুন্ডা বুঝতে পারেন তার গর্ভের সন্তানটি আর বেঁচে নেই। তিনি অনিকার তলপেটে তেল মালিশ করতে শুরু করেন। পরদিন সকালে অনিকা মৃত সন্তান প্রসব করেন। এটি ছিল তার ষষ্ঠ গর্ভধারণ।
অনিকার ১৪ বছরের একটি মেয়ে এবং ৮ বছরের একটি ছেলে আছে। এর আগে ৫ এবং ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা থাকা অবস্থায় তার আরও দুবার গর্ভপাত হয়। তার একটি সন্তান মাত্র দেড় বছর বয়সে রক্তবমি হয়ে মারা যায়।
আনিকার দুটি গর্ভপাত এবং মৃত সন্তান প্রসবের সময়, অপেশাদার ধাত্রী তারামনি মুন্ডা তার দেখাশোনা করেছেন। আনিকা কোনোদিন কোনো হাসপাতাল বা ডিসপেনসারিতে যাননি। কিন্তু সবশেষ মৃত সন্তান প্রসবের পর তিনি ঠিক করেছেন এবার ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর গর্ভধারণ করতে চাই না। আমার যে দুটি সন্তান বেঁচে আছে তাদেরকে নিয়ে আমি সুখে শান্তিতে বাঁচতে চাই।’
শ্রীমঙ্গলের হোসেইনাবাদ চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক মিথিলা নায়েক (২২)-এর অভিজ্ঞতা আমাদের আরও পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেয়, চা বাগানের নারী চা শ্রমিকরা কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে কাজ করেন। তিনি ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি কন্যা শিশুর জন্ম দেন। ৩টি গর্ভপাতের পর মিথিলা এই শিশুর জন্ম দেন। কিন্তু দুপুর বারোটার দিকে সন্তান জন্মদানের দেড় ঘণ্টা পর মিথিলা নায়েককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর মধ্যে মেহগনি গাছের শেকড়ের ওপর বসে থাকতে দেখা যায়।
মিথিলার নবজাতক জন্মের পর কাঁদেনি এবং তার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ তাদের মৌলভীবাজার জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়। মিথিলার স্বামী এবং ভাই গাড়ি খুঁজতে অনেকটা সময় নেন। মা ও শিশু ৪৫ মিনিট মেহগনি গাছের মূলের ওপর বসেছিলেন।
শেষমেশ একটা সিএনজি পাওয়া যায় এবং মিথিলার পরিবার মা ও শিশুকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছাবার ২০ মিনিট পরে নবজাতক কান্না শুরু করে এবং শিশুর প্রাণ রক্ষা পায়।
চা বাগানের বেশিরভাগ গর্ভবতী মা লেবার লাইনে সন্তান প্রসব করেন। প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দেওয়ায় মিথিলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন। যদি তার পরিবার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজারে নিয়ে যেতে পারত তাহলে তার কষ্ট কম হতো। হোসেইনাবাদ চা বাগানের নিজস্ব কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। মিথিলা সিএনজিতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আসেন। খারাপ রাস্তার কারণে যাওয়া এবং আসার সময় তাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। নবজাতককে নিয়ে মৌলভীবাজার থেকে ঘর পৌঁছতে তার সময় লেগেছে দেড়ঘণ্টা।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারী সদস্যরা অপুষ্টিসহ নানা কারণে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬০টি চা বাগানে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার চা শ্রমিকের ৫১ শতাংশই নারী এবং পাতাতোলা শ্রমিকের ৯৫ শতাংশ নারী যারা চা শিল্পের সবচেয়ে কঠিন কাজটি করে থাকেন। নারী চা শ্রমিক, বিশেষ করে যারা গর্ভবতী, গর্ভাবস্থায় প্রচুর যন্ত্রণা ও ভোগান্তির শিকার হন। তারা বেশিরভাগই গর্ভাবস্থার প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত ভারী এবং কঠোর পরিশ্রমের কাজ করেন।
চা বাগানের নারী চা শ্রমিকের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো সন্তান প্রসবের পরে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া। প্রসবের ঠিক পূর্বে তারা তাদের অর্জিত অসুস্থতাজনিত ছুটি নেন এবং ২ থেকে ৩ সপ্তাহ বাড়িতে থাকেন। এ ধরনের চর্চার পরিণতি হলো অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাত এবং মৃত সন্তান প্রসব। তাছাড়া চা বাগানের বেশির ভাগ নারী তাদের বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মেঝেতে করা বিছানায় সন্তান প্রসব করেন। ফলে মা এবং নবজাতক উভয়ই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।
কম বয়সে বিয়ে নারীর স্বাস্থ্যের ওপর আরেকটি বাড়তি চাপ। সাধারণত নারীরাই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখেছে যে ৬০ জন গর্ভবতী নারীর মাঝে ২৯ জনের কম বয়সে বিয়ে হয়েছে এবং ২৯ জন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাদের স্বামীরা কেউই কখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। এসব এবং অন্যান্য আরও নানাবিধ কারণে চা বাগানে গর্ভপাত ও মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড় হারের চাইতে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মৌলভীবাজার জেলায় ১২০টি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৪৮টি বা ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ ঘটে চা বাগানে যেখানে জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এর অর্থ দাঁড়ায় নারী চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে বেশ খারাপ।
বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি)-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে চা বাগানে মালিকপক্ষের পরিচালিত ৭৮টি হাসপাতাল এবং ১৬২টি ডিসপেনসারি রয়েছে। শ্রমিকরা অবশ্য এসব কেন্দ্র থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট। এর কারণ এসব কেন্দ্র যক্ষ্মা ও ক্যানসারসহ গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সেবা দিতে পারে না। প্রসব-পূর্ব এবং প্রসব-পরবর্তী সেবাও এসব স্থানে অপর্যাপ্ত।
চা শ্রমিকদের অবশ্য চা বাগানের কাছে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল যেমন, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক, এসব কেন্দ্রে যেতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই এসব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান। চা শ্রমিকরা সাধারণত সপ্তাহে ৬দিন বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সপ্তাহ শেষে একদিনের ছুটিতে নিজেদের গৃহস্থালির কাজ করেন। তাছাড়া বাগানের বাইরে এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মৌলিক অধিকার এবং শারীরিক ও মানসিক মঙ্গলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এ অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সনদ এবং আইন দ্বারা সংরক্ষিত। চরম দারিদ্র্য, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা, অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন, অশোভন কর্মপরিবেশ, শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালার যেসব ধারা শ্রমিককে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয় সেসবের লংঘন, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চাসহ আরও নানাবিধ কারণে বাগানের নারী ও বালিকারা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত থাকছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি পর্যায়ে পৌঁছালেও এবং স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেসরকারি কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও তা চা বাগানের খুব কম মানুষের উপকারে আসছে। কারণ চা বাগানসমূহ এখনো বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চা শ্রমিক ও তাদের গোষ্ঠীসমূহ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারছে না। আর বেসরকারি উদ্যোগসমূহের পরিধি এখনো সীমিত। আরও যেসব কারণে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেসবের মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মারাত্মক বৈষম্য যার কারণে তারা অপুষ্টির শিকার এবং নিম্ন স্বাক্ষরতার হার তাদের মধ্যে বেশি। এসব কারণে চা শ্রমিক পরিবার দেশে অন্যান্য নাগরিকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ভূমি, বসতভিটা এবং মালিকানাবিহীন চা বাগানের নারী ও বালিকাদের সঠিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।
ফিলিপ গাইন: গবেষক এবং সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউমান ডেভেলপমেন্ট (সেড)-এর পরিচালক। সেড-এর গবেষক ফাহমিদা আফরোজ নাদিয়া লেখককে চা বাগানে ফিস্টুলার ওপর তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছেন।
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)