চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি

চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মৌলভীবাজার শহরের এক প্রাইভেট চেম্বারে তার জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন থেকে তার মৃত্যুর দিন গণনা শুরু। তবে ব্যথা নিয়েও তিনি বাগানে চা পাতা তোলার কষ্টের কাজ অব্যাহত রাখেন। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি সবশেষ কাজে যান। তার ৩ দিন পর ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি বিছানায় পড়েন। সেই দিন থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেননি।

ফিলিপ গাইন
বুধবার মার্চ ৮, ২০২৩ ০৩:৩০ অপরাহ্ন সর্বশেষ আপডেট: বুধবার মার্চ ৮, ২০২৩ ০৩:৩১ অপরাহ্ন
চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি
ছবি: সংগৃহীত
শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক রামদুলারী কৈরি ২০২১ সালের ২৮ মে ৪৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি জরায়ুর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর আগের দিনগুলোতে খুব যন্ত্রণা ভোগ করেন।

২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে মৌলভীবাজার শহরের এক প্রাইভেট চেম্বারে তার জরায়ুর ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন থেকে তার মৃত্যুর দিন গণনা শুরু। তবে ব্যথা নিয়েও তিনি বাগানে চা পাতা তোলার কষ্টের কাজ অব্যাহত রাখেন। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি সবশেষ কাজে যান। তার ৩ দিন পর ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি বিছানায় পড়েন। সেই দিন থেকে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারেননি।

রামদুলারীর ছেলে বাবুল কৈরি (২৭) মায়ের দেখাশোনা করেন এবং তার চিকিৎসার জন্য দেড় লাখের মতো টাকা খরচ করেন। একটি চা শ্রমিক পরিবারের জন্য এটা বড় অংকের টাকা। ‘মাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। তাকে ১০টি কেমোথেরাপি দিয়েছি’, বলেন বাবুল। ‘মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগে মায়ের জবান বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তার খুবই শ্বাসকষ্ট ছিল।’

বাবুল মাকে নিয়ে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন চা বাগানের নারীরা জরায়ুর ক্যানসারের ব্যাপারে মুখ খোলেন না। ক্যানসার যখন শেষের দিকে চলে আসে, তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া কাজ হয় না। ‘ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। বাগান ব্যবস্থাপনা এ খরচ বহন করতে নারাজ। ক্যানসার বা অন্য কোনো কঠিন রোগ হলে রোগী ও তার পরিবারকেই সব খরচ বহন করতে হয়’, আক্ষেপ করে বলেন বাবুল।

‘চা শ্রমিকরা সাধারণত জরায়ু এবং স্তন ক্যানসারের ব্যাপারে অসচেতন এবং অজ্ঞ’, বলেন ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন (আইপিএইচএন)-এর ডিভিশন চিফ, ডা. জয়নাল আবেদিন। তিনি ২০২১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ডা. আবেদিন বলেন এই মারাত্মক অসুখ থেকে সুরক্ষার জন্য স্ক্রিনিং প্রয়োজন; যার ব্যবস্থা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছে। চা বাগানগুলোতে জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে এসিটিক অ্যাসিড দিয়ে চাক্ষুষ পরিদর্শনের জন্য ক্যাম্প করা হয়। ‘আমরা চাক্ষুষ পরিদর্শনের সময় ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে পজিটিভ পাই’, জানান ডা. আবেদিন। এদেরকে নিশ্চিতকরণ (কনফার্মেটরি) পরীক্ষার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

‘বা চাগানে নারীদের জরায়ুর ক্যানসার থেকে রক্ষা করতে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া দরকার এবং এ ব্যাপারে চা বাগান ব্যবস্থাপনা এবং চা শ্রমিকদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে’, পরামর্শ ডা. আবেদিনের। প্রসূতি (অবস্টেট্রিক) ফিসটুলা—ভেসিকো-যোনি ফিস্টুলা (ভিডিএফ) এবং রেক্টো-যোনি ফিস্টুলা যা প্রধানত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের দরিদ্র নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়—বাংলাদেশে, বিশেষ করে চা বাগানে নারীদের মধ্যে একটি উদ্বেগের বিষয়। অল্প বয়সে যেসব মেয়ের বিয়ে হয়, ফিস্টুলায় তাদের বেশি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, কারণ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য শারীকিভাবে প্রস্তুত হবার আগেই তারা গর্ভধারণ করেন এবং সন্তান প্রসব করেন। এর ফলে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় জটিলতা দেখা দেয় এবং তাদের ফিস্টুলা হবার ঝুঁকি থাকে। আবার যাদের ফিস্টুলা হয় তাদের মধ্যে এ রোগের কথা প্রকাশ না করার প্রবণতা আছে।

ইউএনএফপিএ’র অর্থায়নে ও সরকারের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে ইনজুরি প্রতিরোধ ও গবেষণা সেন্টার (সিআইপিআরবি) মৌলভীবাজার জেলার ১০টি চা বাগানে এক গবেষণায় ২০ জন নারীকে ফিস্টুলা থাকতে পারে বলে চিহ্নিত করে। প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে এদের মধ্য থেকে ১৪ জন পজিটিভ (ইতিবাচক) চিহ্নিত করা হয়। এবং তাদেরকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তাদের মধ্য থেকে ৫ জনকে পাওয়া যায় যারা নিশ্চিতভাবে ফিস্টুলায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের সবার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়স হবার আগে এবং তারা সবাই বিয়ে হবার এক বছরের মধ্যে গর্ভবতী হন। ফিস্টুলায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য অল্প বয়সে বিয়ে হওয়াকেই একটি বড় কারণ হিসাবে দেখা হয়। এ রোগের অন্যান্য কারণের মধ্যে অন্যতম বাড়িতে প্রশিক্ষণহীন ধাত্রীর হাতে সন্তান প্রসব এবং প্রসবে দীর্ঘ বিলম্ব।

ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারী শারীরিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হন। সারাক্ষণ প্রস্রাব এবং পূঁজ বের হওয়ায় ক্ষতস্থান ভেজা থাকে এবং দুর্গন্ধ ছড়ায়। ফিস্টুলায় আক্রান্ত নারী অপমানিত হন, স্বামী পরিত্যক্ত হতে পারেন, সমাজে নিগ্রহের শিকার হন এবং সহিংসতারও শিকার হন। চা বাগানে যে ৫ জন নারীর ফিস্টুলায় আক্রান্ত হবার কথা উপরে বলা হয়েছে তারা সবাই প্রথম দিকে আক্রান্ত হবার কথা লুকিয়েছে, তাদের অসুবিধার কথা আমলে নেয়নি এবং ভেবেছে এমনিতে ক্ষত শুকিয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। কেবলমাত্র সঠিক অস্ত্রোপচারই এ রোগের সঠিক নিরাময় করতে পারে।

সিআইপিআরবি’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, ইউএনএফপিএ-এর আর্থিক সহায়তায় এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিআইপিআরবিকে সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০১৯ সালে সিলেট ডিভিশনে ফিস্টুলা নির্মূলের এক কর্মসূচি হাতে নেয়। এ কর্মসূচির আওতায় চা বাগানে ৩৪ জন ফিস্টুলা রোগী চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো হয়। অস্ত্রোপচারের পর এদের মধ্যে ২১ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরেন। ২০২২ সালে ১৯টি বাগানকে ফিস্টুলামুক্ত ঘোষণা করা হয়।

চা বাগানে জরায়ুর ক্যানসার এবং ফিস্টুলা নিয়ে গবেষণাভিত্তিক তথ্য খুব কম এবং মারাত্মক এ ব্যাধি দুটো সম্পর্কে মানুষ খুব কম জানে। কিন্তু চা বাগানে আরও প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে যা সর্বত্র উদ্বেগের কারণ। বর্তমান অবস্থায় সেসব ঝুঁকি সামলানো চ্যালেঞ্জিংও বটে।

এসব ঝুঁকির মধ্যে গর্ভপাত, মৃতসন্তান প্রসব এবং মাতৃমৃত্যু অন্যতম। বিশেষ করে নারী পাতাতোলা শ্রমিকরা দীর্ঘসময় কাজ করেন। পাতাতোলার সেকশনে যাতায়াতে দীর্ঘপথ হাটেন এবং তারা সারাদিন দাঁড়িয়ে কাজ করেন। গর্ভবতী নারীরা সন্তান জন্মদানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করেন এবং তারা নানা প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েন। জাগছড়া চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক অনিকা মুন্ডা এমন স্বাস্থ্যঝুঁকির একজন উপযুক্ত উদাহরণ।

গর্ভধারণের ৭ মাসের মাথায় ১৬ নভেম্বর ২০১৮, অনিকা মুন্ডা একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন। তার আগের দিন পাতা তোলার পর বাড়ি ফেরার পথে তিনি ৪ ঘণ্টা পায়ে হেঁটেছেন। তারপর তার তলপেটে ব্যথা অনুভব করেন। আনিকার শাশুড়ি তারামনি মুন্ডা বুঝতে পারেন তার গর্ভের সন্তানটি আর বেঁচে নেই। তিনি অনিকার তলপেটে তেল মালিশ করতে শুরু করেন। পরদিন সকালে অনিকা মৃত সন্তান প্রসব করেন। এটি ছিল তার ষষ্ঠ গর্ভধারণ।

অনিকার ১৪ বছরের একটি মেয়ে এবং ৮ বছরের একটি ছেলে আছে। এর আগে ৫ এবং ৭ মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা থাকা অবস্থায় তার আরও দুবার গর্ভপাত হয়। তার একটি সন্তান মাত্র দেড় বছর বয়সে রক্তবমি হয়ে মারা যায়।

আনিকার দুটি গর্ভপাত এবং মৃত সন্তান প্রসবের সময়, অপেশাদার ধাত্রী তারামনি মুন্ডা তার দেখাশোনা করেছেন। আনিকা কোনোদিন কোনো হাসপাতাল বা ডিসপেনসারিতে যাননি। কিন্তু সবশেষ মৃত সন্তান প্রসবের পর তিনি ঠিক করেছেন এবার ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলবেন। তিনি বলেন, ‘আমি আর গর্ভধারণ করতে চাই না। আমার যে দুটি সন্তান বেঁচে আছে তাদেরকে নিয়ে আমি সুখে শান্তিতে বাঁচতে চাই।’

শ্রীমঙ্গলের হোসেইনাবাদ চা বাগানের পাতাতোলা শ্রমিক মিথিলা নায়েক (২২)-এর অভিজ্ঞতা আমাদের আরও পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেয়, চা বাগানের নারী চা শ্রমিকরা কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে কাজ করেন। তিনি ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একটি কন্যা শিশুর জন্ম দেন। ৩টি গর্ভপাতের পর মিথিলা এই শিশুর জন্ম দেন। কিন্তু দুপুর বারোটার দিকে সন্তান জন্মদানের দেড় ঘণ্টা পর মিথিলা নায়েককে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স-এর মধ্যে মেহগনি গাছের শেকড়ের ওপর বসে থাকতে দেখা যায়।

মিথিলার নবজাতক জন্মের পর কাঁদেনি এবং তার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ তাদের মৌলভীবাজার জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়। মিথিলার স্বামী এবং ভাই গাড়ি খুঁজতে অনেকটা সময় নেন। মা ও শিশু ৪৫ মিনিট মেহগনি গাছের মূলের ওপর বসেছিলেন।

শেষমেশ একটা সিএনজি পাওয়া যায় এবং মিথিলার পরিবার মা ও শিশুকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে পৌঁছাবার ২০ মিনিট পরে নবজাতক কান্না শুরু করে এবং শিশুর প্রাণ রক্ষা পায়।

চা বাগানের বেশিরভাগ গর্ভবতী মা লেবার লাইনে সন্তান প্রসব করেন। প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দেওয়ায় মিথিলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েছিলেন। যদি তার পরিবার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে শ্রীমঙ্গল থেকে মৌলভীবাজারে নিয়ে যেতে পারত তাহলে তার কষ্ট কম হতো। হোসেইনাবাদ চা বাগানের নিজস্ব কোনো অ্যাম্বুলেন্স নেই। মিথিলা সিএনজিতে করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আসেন। খারাপ রাস্তার কারণে যাওয়া এবং আসার সময় তাকে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। নবজাতককে নিয়ে মৌলভীবাজার থেকে ঘর পৌঁছতে তার সময় লেগেছে দেড়ঘণ্টা।

দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় চা শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারী সদস্যরা অপুষ্টিসহ নানা কারণে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে। সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬০টি চা বাগানে কর্মরত প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার চা শ্রমিকের ৫১ শতাংশই নারী এবং পাতাতোলা শ্রমিকের ৯৫ শতাংশ নারী যারা চা শিল্পের সবচেয়ে কঠিন কাজটি করে থাকেন। নারী চা শ্রমিক, বিশেষ করে যারা গর্ভবতী, গর্ভাবস্থায় প্রচুর যন্ত্রণা ও ভোগান্তির শিকার হন। তারা বেশিরভাগই গর্ভাবস্থার প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত ভারী এবং কঠোর পরিশ্রমের কাজ করেন।

চা বাগানের নারী চা শ্রমিকের একটি সাধারণ প্রবণতা হলো সন্তান প্রসবের পরে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া। প্রসবের ঠিক পূর্বে তারা তাদের অর্জিত অসুস্থতাজনিত ছুটি নেন এবং ২ থেকে ৩ সপ্তাহ বাড়িতে থাকেন। এ ধরনের চর্চার পরিণতি হলো অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাত এবং মৃত সন্তান প্রসব। তাছাড়া চা বাগানের বেশির ভাগ নারী তাদের বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মেঝেতে করা বিছানায় সন্তান প্রসব করেন। ফলে মা এবং নবজাতক উভয়ই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।

কম বয়সে বিয়ে নারীর স্বাস্থ্যের ওপর আরেকটি বাড়তি চাপ। সাধারণত নারীরাই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখেছে যে ৬০ জন গর্ভবতী নারীর মাঝে ২৯ জনের কম বয়সে বিয়ে হয়েছে এবং ২৯ জন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু তাদের স্বামীরা কেউই কখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেননি। এসব এবং অন্যান্য আরও নানাবিধ কারণে চা বাগানে গর্ভপাত ও মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড় হারের চাইতে বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মৌলভীবাজার জেলায় ১২০টি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৪৮টি বা ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ ঘটে চা বাগানে যেখানে জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এর অর্থ দাঁড়ায় নারী চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা জাতীয় পর্যায়ের চেয়ে বেশ খারাপ।

বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি)-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে চা বাগানে মালিকপক্ষের পরিচালিত ৭৮টি হাসপাতাল এবং ১৬২টি ডিসপেনসারি রয়েছে। শ্রমিকরা অবশ্য এসব কেন্দ্র থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট। এর কারণ এসব কেন্দ্র যক্ষ্মা ও ক্যানসারসহ গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সেবা দিতে পারে না। প্রসব-পূর্ব এবং প্রসব-পরবর্তী সেবাও এসব স্থানে অপর্যাপ্ত।

চা শ্রমিকদের অবশ্য চা বাগানের কাছে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল যেমন, জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক, এসব কেন্দ্রে যেতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই এসব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান। চা শ্রমিকরা সাধারণত সপ্তাহে ৬দিন বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকে এবং সপ্তাহ শেষে একদিনের ছুটিতে নিজেদের গৃহস্থালির কাজ করেন। তাছাড়া বাগানের বাইরে এসব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাওয়াটা তাদের জন্য বেশ ব্যয়বহুল।

যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মৌলিক অধিকার এবং শারীরিক ও মানসিক মঙ্গলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর এ অধিকার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সনদ এবং আইন দ্বারা সংরক্ষিত। চরম দারিদ্র্য, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা, অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন, অশোভন কর্মপরিবেশ, শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালার যেসব ধারা শ্রমিককে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয় সেসবের লংঘন, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চাসহ আরও নানাবিধ কারণে বাগানের নারী ও বালিকারা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং অধিকার থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত থাকছে।

সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি পর্যায়ে পৌঁছালেও এবং স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেসরকারি কিছু উদ্যোগ দৃশ্যমান হলেও তা চা বাগানের খুব কম মানুষের উপকারে আসছে। কারণ চা বাগানসমূহ এখনো বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে চা শ্রমিক ও তাদের গোষ্ঠীসমূহ সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারছে না। আর বেসরকারি উদ্যোগসমূহের পরিধি এখনো সীমিত। আরও যেসব কারণে তাদের জীবন ও জীবিকার ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেসবের মধ্যে অন্যতম অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এবং মারাত্মক বৈষম্য যার কারণে তারা অপুষ্টির শিকার এবং নিম্ন স্বাক্ষরতার হার তাদের মধ্যে বেশি। এসব কারণে চা শ্রমিক পরিবার দেশে অন্যান্য নাগরিকদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। ভূমি, বসতভিটা এবং মালিকানাবিহীন চা বাগানের নারী ও বালিকাদের সঠিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি।

ফিলিপ গাইন: গবেষক এবং সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউমান ডেভেলপমেন্ট (সেড)-এর পরিচালক। সেড-এর গবেষক ফাহমিদা আফরোজ নাদিয়া লেখককে চা বাগানে ফিস্টুলার ওপর তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করেছেন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

চা বাগানে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি

Why do women in tea gardens face higher reproductive health risks

Philip Gain | The Daily Star | News Link

Mithila Nayek, sitting on the root of a mahogany tree with her newborn an hour half after the delivery. Photo: Philip Gain

Ramdulari Kairi, a tea leaf picker at of Satgaon Tea Estate in Sreemangal, died on May 28, 2021, at the age of 48. She had cervical cancer, and was in severe pain in the final days of her life.

A private doctor in Moulvibazar had diagnosed Ramdulari in November 2019. Her days were numbered since then. However, she kept working in the tea garden despite the pain. Her last day of work was December 29, 2020. From January 2, 2021, she was bedridden until her death.

Her son Babul Kairi (27) took care of his mother and paid her medical expenses of Tk 150,000 (USD 1,660), a big sum for a tea worker’s family.  “I tried to save my mother. We gave her ten sessions of chemotherapy,” said Babul. “She had breathing difficulties during this time. She stopped talking 12 hours before her death.”

Babul knows from experience that women with cervical cancer in the gardens, like his mother, generally hide their diagnosis. By the time it reaches an advanced stage, it’s too late for surgical treatment. “The cost of cancer treatment is high, which the garden management does not bear. The tea workers or their families generally bear the medical expenses when one has a serious illness, such as cancer,” laments Babul.

“Tea workers are generally unaware and ignorant of cervical and breast cancers,” says Dr Zainal Abedin, division chief of the Institute of Public Health and Nutrition (IPHN) and former Upazila Health and Family Planning Officer in Sreemangal.

According to him, the best precaution for this fatal disease is screening, which is done in upazila health complexes. Visual Inspection of Cervix with Acetic Acid (VIA) camps are also run in the tea gardens to detect cancer. “When we run visual tests, two to four percent come back positive,” he said. The positives are then sent to Sylhet Osmani Medical College Hospital for confirmatory testing.

“To protect women tea workers from cancer, the government should run special camps, and both tea garden management and tea workers should come forward. Surgery at the primary stage can heal one diagnosed with such cancer,” suggests Dr Abedin.

Mithila Nayek with her baby in her house in the labour line of Jagcherra Tea Estate. Photo: Philip Gain

Obstetric fistula, vesico-vaginal fistula (VVF) and recto-vaginal fistula (RVF), prevalent among poor women, mostly in low and lower-middle income countries like Bangladesh, is another serious health concern, particularly in the tea gardens. Those married at an early age are more vulnerable to fistulas, since they give birth to children before they are physically ready to do so. This leads to complications at birth, although those who develop fistula have a tendency to hide it.

A 2018 study, conducted in 10 tea gardens in Moulvibazar district by the Centre for Injury Prevention and Research (CIPRB), identified 20 suspects with fistula. Fourteen were initially screened as positive using a primary diagnosis questionnaire, and were sent to a primary healthcare centre. Five of them were then identified as confirmed cases. All of these five women were married before 16 years of age and became pregnant the following year. This is seen as a key factor for developing obstetric fistula. Home childbirths with untrained birth attendants or long delays in delivery are other key factors behind this.

Fistulas can lead women to suffer through physical and social ordeals. Continuous urination or leakage is not only uncomfortable and embarrassing; it can lead to women being abandoned by their husbands, shunned by their community, and can even make them vulnerable to violence. The five women with fistula initially hid their symptoms, ignoring their discomfort and believing it would go away by itself, even though the only solution is surgery.

The Directorate General of Health Services (DGHS), with the support of UNFPA and CIPRB, initiated a fistula elimination programme in Sylhet division in January 2019. They identified 34 fistula cases in the tea gardens, and sent the patients to a specialised hospital in Dhaka for treatment. Twenty-one of them were completely healed after surgery, and 15 tea gardens were declared fistula free in 2022.

While research-based information on cervical cancers and fistula in tea gardens are scanty, leading to a lack of awareness, there are other reproductive health risk factors for women that are more widespread. These are miscarriage, stillbirth and maternal death, which continue to be huge challenges in current conditions. Women leaf-pickers, in particular, work very long hours, walk many miles to travel to and from their workplaces, and are on their feet all day. Pregnant women keep working till the end of their pregnancy, and experience various health risks.

Anika Munda (29), a tea leaf picker of Jagcherra Tea Estate, is one such woman. Pregnant for seven months, she delivered a stillborn baby on November 16, 2018. She walked four hours to return home after picking tea leaf the day before. Then, she felt pain in her belly. Anika’s mother-in-law Taramoni Munda realised that the fetus was no longer moving. She began massaging Anika’s belly with oil, and the next morning, she delivered Anika’s deceased child. This was her sixth pregnancy.

Anika, who has a 14-year-old daughter and eight-year-old son, has had two miscarriages before, at five and seven months of pregnancy. Another child of hers died of haemoptysis at 1.5 years old.

During Anika’s two miscarriages and the stillbirth, Taramoni Munda, an untrained birth attendant, took care of her.  Anika never visited a hospital or dispensary. But she is finally determined to consult a doctor about family planning methods. “I don’t want to get pregnant again. I want to be happy with my two surviving children,” she said.

The case of Mithila Nayek (22), a tea leaf picker from Hossainabad Tea Garden in Sreemangal, further points to the deep-seated issues that pregnant women face in the gardens. She gave birth to a baby on October, 6 2018, at Sreemangal Health Complex, after having three miscarriages before. An hour and a half after giving birth, Mithila was found sitting on the thick root of a mahogany tree in front of the upazila health complex. Her newborn did not cry at birth, and was having trouble breathing.

These are miscarriage, stillbirth and maternal death, which continue to be huge challenges in current conditions. Women leaf-pickers, in particular, work very long hours, walk many miles to travel to and from their workplaces, and are on their feet all day. Pregnant women keep working till the end of their pregnancy, and experience various health risks.

The health complex authority referred her to Moulvibazar District Hospital. While her family members struggled to find a transportation to Moulvibazar, the mother and child spent 45 minutes waiting on the roots of the mahogany tree. Finally, the family found a CNG to take them and, thankfully, the baby cried 20 minutes after their arrival in the district hospital and survived.

Most mothers in the tea gardens give birth in the garden’s labour lines. Mithila only went to the upazila health complex because she had delivery-related complications, and she was able to return home with her baby. Had her family managed an ambulance to take her from Sreemangal to Moulvibazar, she would have suffered less, but there is no ambulance in Hossainabad Tea Garden to take patients in critical condition to hospitals.

Mithila travelled to the health complex by a CNG – an hour-long journey made even more difficult by the bumpy roads. She returned home from Moulvibazar along the same bumpy road, spending an hour and a half in a rickety CNG with her new baby.

Compared to other parts of the country, tea workers and their family members, especially women, face greater health risks, mainly due to malnutrition and other factors. Fifty-one percent of around 138,000 tea workers in 160 tea gardens in Sylhet and Chattogram divisions are women, as are 95 percent of the tea leaf pickers, who engage in the hardest labour in the tea industry. The sufferings of women workers are only exacerbated when they are pregnant, especially since most of them continue to do their heavy work throughout their pregnancies.

A general tendency among women workers is to take maternity leave only after child birth. Before birth, they sometimes take their earned sick leave and stay home for two to three weeks. Miscarriages and stillbirths are unavoidable consequences of this practice. Besides, most women in the tea gardens deliver their babies on beds set on floors in unhygienic environments, which endanger both mothers and their newborns.

Women workers in tea garden trucks heading for tealeaf picking. Photo: Philip Gain

The fact that many women and girls are married off at an early age only adds to the dangers. In these scenarios, it is always the women who adopt birth control methods. In a 2018 survey on 60 pregnant women, the Society for Environment and Human Development (SEHD) found that 29 were forced to marry early, and 29 adopted birth control methods. But none of their husbands ever adopted any birth control method. These, and many other factors, lead to more miscarriages and maternal deaths in the tea gardens than the national average.

According to the Department of Health, there were 120 maternal deaths in Moulvibazar district in 2014, of which 48, or 39.1 percent, occurred in the tea gardens, despite there being a much smaller population who live here. This means the health condition of female tea workers is worse than the national average.

It is true that government health services have reached the community level, and there are also some non-state initiatives. But the reality is that most tea gardens are still largely secluded, and the tea workers and their communities have many social and cultural barriers in taking full advantage of health services provided by state and non-state facilities.

According to a 2020 report from Bangladesh Tea Board (BTB), there are 78 hospitals and 162 dispensaries run by garden owners. The workers, however, are very unhappy with the services they get from these health facilities, which are unable to provide treatment for critical diseases, including tuberculosis and cancer. Prenatal and postnatal care that the company facilities provide is also very inadequate.

The tea workers, however, can go to the government hospitals, such as the District Sadar Hospital, upazila health complex, union health and family welfare centre, and community clinic, which are close to the tea gardens. However, few of them visit these public health facilities. The tea workers usually remain busy in the gardens, six work days a week, and do household chores on the one day of the weekend. Traveling all the way to health facilities outside the gardens is also costly for them.

Access to proper sexual and reproductive health care is a fundamental right, and extremely important for the physical and mental well-being of women and girls. This right is protected by a number of international charters and laws, including the Universal Declaration of Human Rights. Women and girls in the tea gardens are deprived of sexual and reproductive health rights to a great extent due extreme poverty, lack of awareness and knowledge about government health services, ignorance about family planning, poor hygiene and sanitation, indecent work conditions, violation of labour laws and rules by employers and withholding of the benefits they are entitled to, inadequate access to health workers, lack of education, and various other factors, including social and cultural practices in the tea gardens.

It is true that government health services have reached the community level, and there are also some non-state initiatives. But the reality is that most tea gardens are still largely secluded, and the tea workers and their communities have many social and cultural barriers in taking full advantage of health services provided by state and non-state facilities. Economic hardship, which leads to malnourishment and lower literacy, is a key factor that has multiplier effects on the lives and livelihoods of tea workers. All of this means that special attention to ensure proper sexual and reproductive healthcare for women and girls in the tea gardens is now a necessity.

Philip Gain is a researcher and director at the Society for Environment and Human Development (SEHD). Fahmida Afroze Nadia, SEHD researcher, assisted the author in collation of information on fistula.

চা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ন্যায্যতা কোথায়

চা শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে ন্যায্যতা কোথায়

ফিলিপ গাইন | Newspaper Link
সোমবার, জানুয়ারি ৩০, ২০২৩ ০৩:২৮ অপরাহ্ন | মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-শ্রমিকদের ধর্মঘট। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা

চা শ্রমিকের অর্থনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ হয় যেসব বিষয়ের মাধ্যমে তার মধ্যে অন্যতম মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যকার ২ বছর অন্তর হওয়া চুক্তি। সেখানে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশীয় চা সংসদ এবং শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন।

বাংলাদেশীয় চা সংসদ যেখানে চা বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ১ লাখ ৩৮ হাজার চা শ্রমিকের একমাত্র ইউনিয়ন এবং তাদের সম্মিলিত দরকষাকষির প্রতিনিধি (সিবিএ)।

এই ২ পক্ষের মধ্যে দ্বিবার্ষিক চুক্তি কখনোই সময়মতো সই হয় না। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর চুক্তি সই হয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ মাস পর চুক্তি সই হয়। চুক্তি সই হওয়ার পর বাগান মালিকরা ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২৬ মাসের বাড়তি মজুরি বকেয়া হিসেবে ৪ কিস্তিতে পরিশোধ করে। এই ২৬ মাসে প্রতিদিনের বাড়তি মজুরি ছিল ১৮ টাকা।

চা বাগানে এভাবে বকেয়া মজুরি পরিশোধ রীতিতে পরিণত হয়ে গেছে।
আরও জটিল বিষয় হচ্ছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের জন্য চুক্তি এখনো সই হয়নি।

মজুরি নিয়ে চরম অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে এবং মজুরি না বাড়ানোর ব্যাপারে মালিকপক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে ২০২২ সালের ৯ থেকে ২৭ আগস্ট নজিরবিহীন ধর্মঘট পালন করেন চা শ্রমিকরা। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ তাদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা বাড়ানো হলো। শ্রমিকদের যেখানে দাবি ছিল ৩০০ টাকা।

দাবি পুরোপুরি পূরণ না হলেও ২০ মাসের বকেয়া বাবদ ৩০ হাজার টাকা পাবেন, এমন আশা নিয়ে ২৮ আগস্ট থেকে তারা কাজে যোগদান করেন।

বাংলাদেশীয় চা সংসদের সচিব ড. কাজী মুজাফর আহমেদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘স্থায়ী শ্রমিকরা বকেয়া বা এরিয়ার পাবেন এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে আলোচনা করে আমরা ঠিক করবো কতো কিস্তিতে বকেয়া শোধ করা হবে। তবে সংসদ অস্থায়ী শ্রমিকদের বকেয়ার ব্যাপারে কিছু করবে না, কারণ তারা আমাদের পরিধির মধ্যে পড়ে না।’

অনেক বাগানে বকেয়া পরিশোধের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু চা শ্রমিকদের জন্য বড় দুঃস্বপ্ন হলো মালিকপক্ষ চুক্তি সই নিয়ে গড়িমসি শুরু করে।

চুক্তির ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে শ্রমিকপক্ষ ও মালিকপক্ষ ধর্মঘটের আগে ১৫টির মতো সভা করে। ধর্মঘটের পরে তারা আরও বেশ কয়েকটি সভা করে। সভায় অংশগ্রহণকারী শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, তাদেরকে অবাক করে মালিকপক্ষ বকেয়ার পুরো টাকা তো দূরের কথা, আংশিকও পরিশোধ করতে রাজি নয়। কাজেই শ্রমিকরা ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট থেকে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি পেলেও এখনো ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মেয়াদকালের চুক্তি সই হচ্ছে না।

এ পরিস্থিতি চা বাগানে বকেয়া মজুরি পরিশোধের ব্যাপারে প্রচলিত নিয়মনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সাধারণ শ্রমিকরা বকেয়ার ব্যাপারে কোনো রকম ছাড় দিতে নারাজ। নারী চা শ্রমিক এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের জুরি ভ্যালির ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্রীমতি বাউরি বলেন, ‘মালিক ও শ্রমিকের চুক্তিপত্র দেরিতে সই হয় এবং আমরা একটি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী মেয়াদের প্রথম দিন থেকে অতিরিক্ত মজুরি বকেয়া হিসেবে পেয়ে থাকি। আমরা পূর্ণমেয়াদের জন্য দৈনিক ৫০ টাকা হারে বকেয়া চাই।’

পাতাতোলা শ্রমিক কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের বিশাখা (৪০) বলেন, ‘মালিকপক্ষ যদি চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর না করে এবং আমাদের বকেয়া পুরোপুরি শোধ না করে, তবে আমরা আবার আন্দোলন করব।’ তিনি দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি পাচ্ছেন এবং দুর্গাপূজার সময় ৫ হাজার ৩০৪ টাকা উৎসব ভাতা পেয়েছেন। এই টাকা বার্ষিক উৎসব ভাতার ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৫৩৬ টাকা তিনি পাবেন ফেব্রুয়ারির ফাগুয়া উৎসবে। তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট পর্যন্ত পুরো সময়টা কাজ করেছেন। ২০ মাসের বকেয়া বাবদ তার ৩০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা।

দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এবং চা শ্রমিকদের একমাত্র ইউনিয়নের নেতারা মালিকপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষিতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। অসহায় শ্রমিক নেতারা ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো এক আবেদনে উল্লেখ করেছেন, গত চুক্তির মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পরদিন থেকে মালিকপক্ষ বর্ধিত মজুরি বকেয়া হিসেবে পরিশোধ করতে গড়িমসি করছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অভিযোগ মালিকপক্ষের একরোখা মনোভাবের কারণে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কোনো চুক্তি সই হয়নি।

২০২১-২০২২ সালের ২ বছর মেয়াদী চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ দিন আগে ৭ ভ্যালির ৭ সহসভাপতি এবং বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩ সদস্য শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে ঢাকায় এক বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ইউনিয়নের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বকেয়া পরিশোধের ব্যাপারে বাংলাদেশীয় চা সংসদ দৈনিক ৫০ টাকা নয় ১৭ টাকা দিতে চাচ্ছে। কিন্তু ইউনিয়নের অধিকাংশ নেতা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কোনো রকম ফলাফল ছাড়া সভার সমাপ্তি ঘটে।

যেকোনো শিল্পেই শ্রমিকদের জন্য যথাযথ মজুরি বোর্ড কাম্য। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় চা শ্রমিকের মজুরি লজ্জাজনকভাবে কম নির্ধারণ করেছে এ পর্যন্ত গঠিত ৩টি মজুরি বোর্ড। প্রথমত চা শিল্পে নূন্যতম মজুরি বোর্ড অনিয়মিত অর্থাৎ প্রতি ৫ বছর পরপর গঠিত হয়নি। দ্বিতীয়ত সর্বশেষ মজুরি বোর্ড তার এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তার ফল মোটেও ভালো হয়নি। গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী ১৭০ টাকা মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার পর এখনো ২০১৯ সালের অক্টোবরে গঠিত মজুরি বোর্ড আনুষ্ঠানিকতা সেরে মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করতে পারেনি।

যেকোনো শিল্পে মজুরি নির্ধারণের দায়িত্ব বর্তায় নূন্যতম মজুরি বোর্ডের উপর। কিন্তু চা শিল্প সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি শিল্প। এ শিল্পের শ্রমিকরা চা বাগানের সীমানার মধ্যে বাস করেন। তাদের নিজেদের কোনো ভিটেমাটি নেই। উত্তরবঙ্গ বাদ দিয়ে চা বাগানের বাকি সব জমির মালিক রাষ্ট্র।

কাজেই মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের এখনকার দাবি ‘এখন থেকে মজুরি বোর্ডই মজুরি নির্ধারণ করুক’, এটা শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা না করে মানা সম্ভব নয়।

শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরীর মতে, মালিকদের আরেকটি প্রস্তাব হচ্ছে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে চুক্তি ৩ বছর পরপর হোক। আর যদি রীতি অনুযায়ী ২ বছর পরপরই তা হয়, তাহলে এ চুক্তি হবে মজুরি বাদে অন্যান্য বিষয় নিয়ে। মালিকপক্ষের এসব দাবি শ্রমিক প্রতিনিধি রামভজন কৈরী মানেননি। তার যুক্তিসঙ্গত মত হলো, শ্রমচুক্তি ও মজুরি বোর্ডের এসব বিষয় ফয়সালা হতে হবে মালিক, শ্রমিক ও সরকারপক্ষের মধ্যে উন্মুক্ত ও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে এবং অবশ্যই শ্রমিকের স্বার্থ বিবেচনা করে।

চা শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ ও মজুরি বোর্ডে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আশার জন্য মালিকপক্ষকে এখনই শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে ২০২১ সারের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সারের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তি সই করা উচিত। এরপর ২০২৩ সালে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন চুক্তির মেয়াদ শুরু হয়ে যাবে। আর নূন্যতম মজুরি বোর্ডকেই যদি চা শিল্পে মজুরি নির্ধারণ করতে হয়, তবে শ্রম আইনের ১৪১ ধারা অনুসরণ করে চা শ্রমিকের জীবনযাপনের ব্যয় এবং অন্যান্য শিল্পের নূন্যতম মজুরি বিবেচনায় নিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে।

ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের পরিচালক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

No justice in paying tea workers’ arrears

No justice in paying tea workers’ arrears

by Philip Gain | Newsper Link
Sun Jan 29, 2023 08:00 AM Last update on: Sun Jan 29, 2023 08:00 AM | PHOTO: MOSTAFA SHABUJ

Foremost of the factors that determine the economic fate of tea workers in Bangladesh is the agreement that the Bangladesh Tea Association (BTA) and Bangladesh Cha Sramik Union (BCSU) sign every two years. While BTA represents owners of the tea gardens, BCSU is the only trade union for around 1,38,000 tea workers and their combined bargaining agent (or CBA).

However, this bi-annual agreement is never signed on time. For instance, the agreement effective for January 1, 2019 to December 31, 2020 was signed on February 25, 2021. The tea workers got their additional pay for 26 months in arrears in four instalments. Additional cash pay for these 26 months was Tk 18 per day.

For all latest news, follow The Daily Star’s Google News channel.

More baffling is the fact that no agreement has yet been signed for the period from January 1, 2021 to December 31, 2022. Such payment of arrears has become part of the culture in Bangladesh’s tea gardens.

Extremely dissatisfied with this delay and the stubbornness of BTA in not increasing wages, the tea workers went on an unprecedented strike from August 9 to 27 in 2022. Finally, the prime minister stepped in and fixed the daily cash pay at Tk 170, which is an increase of Tk 50 and Tk 130 less than what workers had demanded.

Still, they went back to work from August 28 in hopes that they would get the increased wage from January 2023. A registered worker who had worked all days during the 20-month arrear period would get Tk 30,000, a good sum for the impoverished tea workers.

Dr Kazi Muzafar Ahmed, secretary of the BTA, said in an interview with The Business Post last August, “The permanent workers will get arrears, and we will set the number of instalments in a meeting with the BCSU. The association will not facilitate any arrears for casual workers, as they are out of our purview.” Some gardens were preparing to roll such payment as well.

But the owners’ fickleness about signing of the agreement has come as a big shock to tea garden workers.

The BTA and BCSU had already had 15 meetings before the August 2022 strike, to reach an agreement. After the strike ended, they held several meetings. The tea workers’ representatives were shocked to find that owners were now reluctant to even pay part of the arrear, let alone the full. So, even though workers started receiving the daily cash pay of Tk 170 from August 28, 2022, there has been no headway for signing the January 1, 2021 to December 31, 2022 agreement. This situation contravenes the tradition regarding payment of arrears.

And common tea workers are reluctant to compromise: “The agreement between the owners and workers is signed late and we get the increased pay in arrears from the first day of the following agreement period,” says Sreemati Bauri (40), a tea worker and vice president of BCSU’s Juri Valley committee. “We want our full arrears at the rate of Tk 50 per day for the full agreement period.”

“If the owners do not sign and execute the agreement starting from January 1, 2021 and do not pay our arrears in full, we will go on strike again,” said tealeaf picker Bisakha (40) of Madhobpur Tea Estate in Kamalganj upazila.

The leaders of BCSU are having a hard time negotiating with the owners. Helpless, they have sent an appeal to the PM dated November 14, 2022 in which they pointed out that the owners are now reluctant to pay the increased daily wage starting after the expiration of the last agreement period. BCSU alleges that the arrogance of the owners is causing delay in the signing of the agreement even after the agreement period ended on December 31, 2022.

Three days before the end of the 2021-22 agreement period, a 10-member team of seven vice presidents of seven valleys and three central committee members of BCSU met the Director General of the Department of Labour (DL) in Dhaka. A number of the labour leaders have said that they have learned from an official of the Department of Labour that the owners were willing to pay the arrears at the rate of Tk 17 a day, not Tk 50. Some BCSU leaders were reportedly ready to compromise and accept arrears between Tk 25 and Tk 30. But the majority of leaders rejected this and the meeting ended with no positive outcome.

The three minimum wage boards set up so far for the tea industry have fixed much lower wages compared to other industries. First, the minimum wage board is irregular in the tea industry as it is not formed every five years. Second, the latest minimum wage board interfered in affairs beyond its jurisdiction and the outcome turned out to be unpredictably sad. The current wage board, set up in October 2019, has not even published the gazette finalising the wage structure.

In any industry, the responsibility of fixing wages is bestowed upon the minimum wage board. However, the tea industry is entirely exceptional. The workers in this industry live within the boundaries of the tea gardens. They do not have homesteads of their own. The state owns the land of the tea gardens, excluding those in north Bengal.

Therefore, the current proposal of the BTA to the government to “let the minimum wage board fix the wage” is not acceptable without elaborate discussion with workers.

According to Rambhajan Kairi, the workers’ representative, another BTA proposal is that the agreement between the BTA and BCSU be signed every three years. BTA also suggests if the agreement is signed every two years following the long tradition, it should deal with all other issues except wages. But Kairi’s reasonable argument is that the owners, tea workers, and the state must have open and elaborate discussions before bringing any change to the current tradition. And the workers’ interest must get the right consideration in such discussions.

For an exit out of the current stalemate, the BTA should immediately accept the legitimate demand of tea garden workers and sign the agreement for the period from January 1, 2021 to December 31, 2022. Then, the negotiation would be due for the following agreement period starting on January 1, 2023. On another note, if the minimum wage board is regularised in the tea industry, it must grant pragmatic consideration to the living costs of tea workers and other factors that section 141 of the labour laws mentions.

Phillip Gain is researcher and director at the Society for Environment and Human Development (SEHD).

একতাই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অন্যতম উপায়

একতাই নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে অন্যতম উপায়

“সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি আরো আছে নারী ও মেয়েদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা, যা সহিংসতার আরেকটি মাত্রা। এসবের যারা শিকার তাদের কথা ধৈর্য্য সহকারে শোনার মানুষের সংখ্যা অনেক কম বাংলাদেশে। এই শোনার জায়গাটা তৈরি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”

নারীর প্রতি সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন সহিংসতা বিষয়ে এভাবেই মতামত তুলে ধরেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ও ব্রাত্যজন রিসোর্স সেন্টার (বিআরসি)-এর গবেষণা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিআরসি, সোসাইটি ফর এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), পিপিআরসি ও সহযোগী সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ৩০ নভেম্বর ২০২২ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে ড. রহমান মত ব্যক্ত করেন। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের প্রচারাভিযান উদযাপন উপলক্ষে এই আলোচনা সভা ও এর সাথে ট্রান্সজেন্ডার সাংস্কৃতিক দলের একটি মনোজ্ঞ পরিবেশনার আয়োজন করা হয়।
যৌনকর্মী (যৌনপল্লী, রাস্তা ও হোটেলে কর্মরত), হিজড়া (ট্রান্সজেন্ডার), নারী চা শ্রমিক, বেদে নারী, মানবাধিকার কর্মী ও মহিলা সাংবাদিকসহ প্রায় ৮০ জন প্রতিনিধি নারীর প্রতি সংহতি প্রদর্শনপূর্বক এই সভায় মিলিত হন। এই প্রচারাভিযান বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদযাপিত হয় এবং ২০২২ সালে-এর মূল সুর ছিল ‘এক হও! নারী ও কন্যার উপর সহিংসতা বন্ধে প্রচারাভিযান’।

আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্যে সেড’র পরিচালক ফিলিপ গাইন নারী চা শ্রমিক, যৌনকর্মী, হিজড়া, আদিবাসী নারী এবং বেদে নারীদের সাথে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের সহিংসতা এবং তাদের বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেন।

আলোচনা সভার গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, চরম বৈষম্য ও বঞ্চনা ইত্যাদির শিকার নারীদের কণ্ঠস্বর সামনে নিয়ে আসা।
মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত শমশেরনগর চা বাগানের একজন শিক্ষিকা ২০১৫ সালে গণ-ধর্ষণের শিকার হন। তিনি তার সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, “ধর্ষণের ঘটনা প্রথমে গোপন রাখার চেষ্টা করেছি, আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি। পরবর্তীতে আমি আমার পরিবার এবং ডাক্তারকে ঘটনা খুলে বলি এবং ন্যায়বিচারের আশায় মামলা করি। কিন্তু মামলা করেও আজ পর্যন্ত আমি ন্যায়বিচার পাইনি। মামলার আসামীরা আজ জামিন নিয়ে জেলের বাইরে। তারপরও, এখনো আমি ন্যায় বিচার ও আসামীর শাস্তি হোক এটাই চাই।”

ট্রান্সজেন্ডার নারী অধিকার কর্মী জয়া সিকদার হিজড়াদেও অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি তাদের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, “হিজড়া একটি পেশা বা সংস্কৃতি, এটা কোনো লৈঙ্গিক পরিচয় নয়। লৈঙ্গিক পরিচয়ের এই জায়গাটা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত।”

বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ফাল্গুনি ত্রিপুরা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এফআইআর করতে গেলে ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক তথ্য এদিক-ওদিক হয়ে যায়, ঠিকভাবে নথিভুক্ত হয় না। গোঁড়াতেই এমন গÐগোল হলে ন্যায়বিচারের আশা কীভাবে করা যায়!”

দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা লিলি বেগম গত ১০ নভেম্বর ২০২১ থেকে নিখোঁজ। এখন পর্যন্ত কোনো সুষ্ঠ তদন্ত বা আদালতে কোনো বিচার হলো না। আমরা জানতে চাই লিলি কি বেঁচে আছে কি না,” কাঁদতে কাঁদতে বলেন দৌলতদিয়া থেকে আসা কুমলি নামের এক যৌনকর্মী। পদ্মার পাড়ে রাজবাড়ী জেলায় অবস্থিত দৌলতদিয়া বাংলাদেশের ১১টি যৌনপ্ললীর মাঝে সর্ববৃহৎ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম যৌনপল্লীর একটি যেখানে প্রায় ১৪০০ জন যৌনকর্মীর অবস্থান। প্রায়শই হত্যাকান্ডসহ চরম সহিংসতার ঘটনা ঘটে এই পল্লীতে।

সভায় অন্যান্য যারা নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন তারা হলেন শিশুদের জন্য আমরা’র সভাপতি হাজেরা বেগম (প্রতিষ্ঠানটি যৌনকর্মীর সন্তান ও পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করে), সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সভাপতি আলেয়া আক্তার লিলি, বৈকন্ঠপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক মনি কল (বাগানের ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার) ও বেদে নারী তিতনা খাতুন।

উপস্থিত বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নেতৃ, আইনজীবি ও মানবাধিকার কর্মী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার মূল কারণগুলো সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন। পাশাপাশি এ ধরনের সহিংসতার শিকার নারীদের সাহায্য প্রদানে, বিশেষ করে আইনি সহায়তা প্রদানে, তারা প্রতিশ্রæতি ব্যক্ত করেন।
বিষেশ অতিথি বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “একজন যৌনকর্মীর ধর্ষণের মামলা করার পূর্ণ অধিকার আছে, তার অভিযোগ লিখতে পুলিশ বাধ্য।”

অ্যাডভোকেট আলী আরো বলেন, “আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে প্রতিদিন, শুধু বছরের এই ষোলো দিন না। আমাদের আরো কাজ করতে হবে, প্রতিরোধ আরো দৃশ্যমান করে তুলতে হবে।”

একাত্তর টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স প্রধান মিথিলা ফারজানা সহিংসতার শিকার নারীদের গল্প সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছানোর বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, “নারীদের সহিংসতা নিয়ে আমাদের গল্প অনেক, কিন্তু শুনছে অনেক কম মানুষ। গল্প উপস্থাপনের কৌশল জানতে হবে, পরিবেশনযোগ্য করে তুলতে হবে। গল্পগুলো শুধু আমরা নারীরা শুনলেই হবে না, পুরুষদেরও জানতে হবে নারীর সংগ্রামের কথা। মিডিয়ার মাধ্যমে এই গল্পগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।”

মিথিলা ফারজানার এই বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু। “আমাদের এখন যা প্রয়োজন তা হলো একতা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। পুরুষকেও এই আন্দোলনে নিয়ে আসতে হবে। সবাই মিলে অধিকার আদায়ে আরো সোচ্চার হতে হবে,” বলেন মিস মিনু।

“একজন ধর্ষণের শিকার নারীকেই কেন প্রমাণ করতে হবে যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন,” প্রশ্ন তুলেন মিনু। “বরং অপরাধীকে প্রমাণ করতে হবে যে সে নিরপরাধ।”

নারীর নিজের গল্প নিজে বলা ও তা নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব সম্পর্কে ড. রহমান বলেন, “নিজের গল্পগুলো বলতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য নারীকণ্ঠকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। এর সাথে হতে হবে কৌশলী। সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে কোথায়, কখন ও কীভাবে নিজের কথা বলতে হবে তার কৌশল রপ্ত করাটা খুব জরুরী।”

সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন মুক্তি মহিলা সমিতির নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম ও আদিবাসী নারী কর্মী তন্দ্রা চাকমা।
হিজড়া সাংস্কৃতিক দলের মনোজ্ঞ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে সভায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা পাঠ ও ছোট নাটিকার মাধ্যমে ট্রান্সজেন্ডার শিল্পীরা নিজেদের প্রতিভা উপস্থাপনের পাশাপাশি সকল নারীর কাছে একটি সুন্দর বার্তা পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করেন—পেশা ও সহিংসতা যে ধরনেরই হোক না কেন, সকল নারী শক্তিশালী, প্রত্যেকের নিজস্ব প্রতিভা আছে, আছে সম্ভাবনা। অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ নারী যেকোন সহিংসতা প্রতিরোধে সক্ষম। বার্তাটি প্রচারাভিযানের এই বছরের প্রতিপাদ্য ‘এক হও! নারী ও কন্যার উপর সহিংসতা বন্ধে প্রচারাভিযান’ এরই একটি প্রতিফলন।